সংস্কৃতি ও রাজনীতি

বানরসদৃশ এক প্রাণী (ape) জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে, পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আপন ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করতে করতে মানুষে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং সেই মানুষ আপন সংস্কৃতিচেতনার বলে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি করে চলছে। মানুষ বুদ্ধিমান এবং উন্নতিপ্রয়াসী প্রাণী। মানুষ পরিবেশকে পরিবর্তন করতে করতে নিজেও পরিবর্তিত হয়েছে। ‘বদলে যাও, বদলে দাও’—এ রকম একটি উক্তি এখানে পাশ্চাত্যে ও প্রাচ্যে কিছু লোকের মুখে শোনা যায়।
গর্ডন চাইল্ডের বিখ্যাত বই ‘Man Makes Himself’. এতে মানুষকে তিনি দেখেছেন উন্নতিশীল প্রাণীরূপে। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে এবং নিজেদের গড়ে তোলা, জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে বিকশিত হয়ে চলা, সেই সঙ্গে পরিবেশকেও উন্নত করে চলা—এরই মধ্যে নিহিত থাকে ব্যক্তির কিংবা সমষ্টির সংস্কৃতি। মানুষ শুধু বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট থাকে না, উন্নতি করতে চায়।
সংস্কৃতি স্বতঃস্ফূর্ততার ব্যাপার যেমন, তেমনি সজ্ঞান, সচেতন, সতর্ক চর্চারও ব্যাপার। উন্নতি বা প্রগতি নির্ভর করে সজ্ঞান চর্চার ওপর। ফ্রয়েডের অনুসরণে বলা যায়, সংস্কৃতি ও প্রগতির জন্য আদিসত্তাকে সংযত করে, বাস্তবসত্তা ও নৈতিক সত্তাকে অবলম্বন করে চলতে হয়। প্রগতি কার্যকর হয় প্রতিক্রিয়ার মোকাবেলা করে, রক্ষণশীলদের সহায়তা নিয়ে। রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলে পার্থক্য আছে।
‘The Descent of Man’ গ্রন্থে ডারউইন উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, কী করে মানুষ জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে নিজের অজান্তেই নিজের জীবনযাত্রার, কাজের ও পছন্দ-অপছন্দের মধ্য দিয়ে নিজেকে সৃষ্টি করে চলছে। এরই মধ্যে উন্নতির সজ্ঞান ও সচেতন প্রয়াসও থাকে—থাকে সাধনা ও সংগ্রাম। মনোগত উন্নতি ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উন্নতি দুয়ের মধ্যেই মানুষের সক্রিয় ভূমিকাতে নিহিত থাকে সংস্কৃতি। সংস্কৃতির বিবেচনায় struggle for existence, natural selection ও survival of the fittest প্রভৃতি ধারণাও বিবেচ্য। সংস্কৃতি ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে যেমন, তেমনি জাতীয় জীবনেরও ব্যাপার।
মানুষকে অস্তিত্ব রক্ষা ও উন্নতি করতে হয় একদিকে প্রকৃতির প্রতিকূল ও অনুকূল নানা শক্তির সঙ্গে জটিল সব সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এবং আপন সমাজের অভ্যন্তরে জটিল সব সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। মানুষের শক্তি হলো তার ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি। শুধু শারীরিক শক্তিই শক্তি নয়, মানসিক শক্তিও শক্তি এবং মানসিক শক্তিও শারীরিক শক্তির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক শক্তি শরীরের বাইরের কিছু নয়। মনকে কখনো শরীর থেকে আলাদা করা যায় না।
ডারউইনের অনুসরণে হার্বার্ট স্পেন্সার ‘Evolution and Ethics’ গ্রন্থে মানুষের নৈতিক চেতনার ক্রমবিকাশের বিবরণ রচনা করেছেন। ইতিহাসের ধারায় পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের নীতিতে আছে অভিযোজন (adaptation) গ্রহণ-বর্জন। পরিবেশের স্পর্শ কিংবা প্রভাব থেকে মুক্ত কোনো চেতনার কিংবা মনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। মানসিক শক্তিও আসলে দেহেরই শক্তি। মানসিক শক্তির মধ্যে থাকে নৈতিক শক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির শক্তি—আদর্শ উদ্ভাবন ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার শক্তি।
নৈতিক উন্নতির জন্য জ্ঞানগত ও চিন্তাগত উন্নতির সঙ্গে পরিবেশের উন্নতি সাধনও অপরিহার্য। মানুষ সেই জৈবিক সামর্থ্যেরও অধিকারী, যার বলে সে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিজের এবং নিজেদের সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। মানুষের বিবর্তনে মানুষের ব্যক্তিগত ও যৌথ সংস্কৃতিচেতনাই কর্তা। সংস্কৃতির মর্মে প্রগতির তাড়না ক্রিয়াশীল থাকে। কল্পিত উন্নত অবস্থায়ই আদর্শ। মানুষ আদর্শ সৃষ্টি করে এবং আদর্শে পৌঁছতে চায়।
শ্রী অরবিন্দ ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘পৃথিবীতে স্বার্গরাজ্য স্থাপনই সংস্কৃতির জীবন্ত লক্ষ্য।’ তাঁর ‘দীব্য জীবন (Life Devine)’ গ্রন্থেও এ রকম চিন্তাই আছে। পার্থিব জীবনকেই তিনি দীব্য জীবনে উন্নীত করার কথা বলেছেন। এ রকম কথা বিভিন্ন দেশে আরো কেউ কেউ বলেছেন। অরবিন্দ প্রথমত মানুষের মনোদৈহিক উন্নতিতে—তারপর আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতিতে গুরুত্ব দিয়েছেন।
যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত দিক দিয়ে পশ্চাত্বর্তী ও দরিদ্র, তাদেরও সংস্কৃতি আছে। জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে তারাও উন্নতি করতে চায়—তাদের মধ্যেও ন্যায়-অন্যায়বোধ, সৌন্দর্যবোধ ও সর্বজনীন ও কল্যাণবোধ আছে। অগ্রসর সংস্কৃতির প্রভাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা সংস্কৃতিমান থাকে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের থেকে, নিজেদের জন্য, নিজেদের চেষ্টায় নেতৃত্ব সৃষ্টি করে তারা শক্তিশালী হতে পারে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অনৈক্যের মধ্যে তারা দুর্বল ও বঞ্চিত থাকে। সংস্কৃতির দাবি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থায় প্রবল ও দুর্বল, ধনী ও দরিদ্র সব মানুষেরই উন্নতির সুযোগ উন্মুক্ত রাখা।
সংস্কৃতি মানবীয় ব্যাপার। মানুষ কৃষ্টিমান বা সংস্কৃতিমান প্রাণী। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীই সংস্কৃতিমান বা কৃষ্টিমান নয়। মানুষ শুধু বেঁচে থেকেই সন্তুষ্ট থাকে না, উন্নতি করতে চায়। ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনে মানুষ পরিবেশকেও উন্নত করতে চায়। এর মধ্যেই থাকে মানুষের সংস্কৃতিমানতা। বেঁচে থাকার ও উন্নতি করার জন্য মানুষকে চিন্তা ও কাজ করতে হয়। অনেক কাজই অন্যদের সঙ্গে মিলে করতে হয়, একা পারা যায় না। সংস্কৃতি হলো সেই শক্তি, যা মানুষের চিন্তা ও কাজে উন্নতিশীলতা, উৎকর্ষমানতা, সৌন্দর্যমানতা, প্রগতিশীলতা ও পূর্ণতা প্রয়াসের মধ্যে বিরাজ করে। সংস্কৃতি হলো ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনে সংস্কার প্রচেষ্টা, উত্তরণ প্রচেষ্টা। জীবনযাত্রার, শিক্ষার ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে এবং নিজের সমাজ ও পরিবেশকে উন্নত, সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার প্রবণতা, চিন্তা ও চেষ্টার মধ্যে নিহিত থাকে সংস্কৃতি। সংস্কৃতিতে সর্বজনীন কল্যাণবোধ, ন্যায়-অন্যায়বোধ ও ন্যায়নিষ্ঠা থাকে। শঠ, প্রতারক ও লোভীর প্রবণতা ও প্রচেষ্টা সংস্কৃতির পরিপন্থী। সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপার, তেমনি যৌথ বা সম্মিলিত জীবনেরও ব্যাপার। তা জাতীয় ব্যাপার, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যাপারও।
ব্যক্তির সংস্কৃতির পরিচয় থাকে তার কর্মে ও ব্যক্তিত্বে। জাতির সংস্কৃতির পরিচয় থাকে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষায়, চিন্তায় ও কর্মে। জাতীয় সংস্কৃতিকে বলা যায় জাতির অন্তর্গত ও জনগণের সমষ্টিগত ব্যক্তিত্ব। তাতে ভালো ও মন্দ দুই-ই থাকে। ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত, ন্যায়-অন্যায়, রীতি-নীতি, আইন, আচার-অনাচার, কর্তব্য-অকর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে জাতির অন্তর্গত জনগণের স্বীকৃত ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে জাতীয় সংস্কৃতি। তবে সর্বস্বীকৃত নয় এমন ধারণাও থাকে প্রত্যেক জাতির অন্তর্গত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জীবনে। কোনো জাতির অন্তর্গত জনগণের সব চিন্তা ও কর্ম এবং উৎপাদন ও সৃষ্টিই সেই জাতির সংস্কৃতির বাহন। প্রত্যেক জাতির সংস্কৃতিতে বিশিষ্টতা ও স্বাতন্ত্র্য আছে। এক জাতির সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য জাতির সংস্কৃতির সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দুই-ই আছে। এক জাতি অন্য জাতির সংস্কৃতি থেকে গ্রহণও করে। উন্নতির জন্য গ্রহিষ্ণুতা অপরিহার্য।
বিভিন্ন জাতির মধ্যে যাঁরা সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তা ও কাজ করেন তাঁদের মধ্যে নানা দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা ও কাজ আছে। আমি এখানে একটি দৃষ্টিভঙ্গি—বলা যায় বিবর্তনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে কিছু কথা বললাম। আজকের বাংলাদেশে, সব রাষ্ট্রেই এই দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে সংস্কৃতিকে বুঝবার প্রচেষ্টা দরকার। গত তিন-চার দশক ধরে সভ্যতা, প্রগতি নিয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনা প্রায় দুর্লভ হয়ে পড়েছে। হান্টিংটনের ‘Clash of Civilizations’ গ্রন্থে সভ্যতার কথা যেভাবে বলা হয়েছে তা জনস্বার্থে নয়, সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদীদের স্বার্থে। সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংস্কৃতিকে গণ্য করা হয় বিনোদনরূপে। নাচ-গান, নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদিতে সংস্কৃতির ধারণা ও চিন্তাকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। বিবর্তনমূলক যে দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে আমি সংস্কৃতিকে বুঝবার কথা বলছি তা সংস্কৃতিকে বিনোদন দিয়ে বুঝবার চেয়ে অনেক বেশি কল্যাণকর। আমি সর্বজনীন কল্যাণের কথা বলছি। কায়েমি স্বার্থবাদীরা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তাদের স্বার্থের প্রতিকূল মনে করবে। সর্বজনীন কল্যাণে সভ্যতা ও প্রগতি সম্পর্কেও নতুনভাবে চিন্তা করা দরকার। নতুন পর্যালোচনায় গেলেই দেখা যাবে, সভ্যতা ও সংস্কৃতি কার্যত একই ব্যাপার। সংস্কৃতি বিষয়ে যেমন নানা ধারণা আছে, তেমনি সভ্যতা বিষয়েও আছে নানা ধারণা। এই সব ধারণা নিয়ে আমরা কী অর্জন করতে চাই, তার ওপর নির্ভর করবে আমাদের ধারণার ধরন। প্রগতির ধারণা সভ্যতা ও সংস্কৃতি দুয়ের মধ্যেই নিহিত থাকে। গত তিন-চার দশক ধরে অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তি নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা যেভাবে চলছে তাতে কায়েমি স্বার্থবাদীরা প্রগতির ধারণাকেও সামনে আসতে দিতে চায় না।
আলোচনা-সমালোচনা আরম্ভ হলেই দেখা যাবে, বিষয়গুলো নিয়ে প্রগতিশীল ধারণা, রক্ষণশীল ধারণা ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা স্পষ্ট রূপ নিচ্ছে। লেখা, পুস্তক-পুস্তিকা, সাময়িক পত্রিকা ও সংবাদপত্রের কোনো বিকল্প নেই। আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে ন্যায়, সত্য ও সুন্দরকে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে হয়।
দুনিয়াজুড়ে এখন উৎপাদন ও বৈষয়িক সম্পদ বেড়ে চলছে। অর্থনৈতিক উন্নতির এই ধারা বাংলাদেশেও চলছে। শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্তের কঠোর শ্রম নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে এটা সম্ভব হচ্ছে। উন্নয়নের এই প্রক্রিয়ায় সরকারের ও রাজনৈতিক দলগুলোরও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। দুর্নীতি ও অপব্যবস্থার কারণে অনেক সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতি যদি ক্রমে দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকত, তাহলে উন্নয়ন আরো বেশি হতো এবং রাষ্ট্র বিধি-বিধান, সর্বজনীন কল্যাণ ও মানবতার বিকাশের অনুকূল হতো।
সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য কোনো সরকারের ও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল না থেকে জনকল্যাণের দিক দিয়ে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের ও পেশামূলক সংগঠনগুলোরও মত প্রকাশ দরকার। তার জন্য প্রগতিকামী প্রচারমাধ্যম দরকার। প্রগতিপ্রয়াসী প্রচারমাধ্যম গড়ে তোলা দরকার। সেটা কঠিন কাজ, তবে অসম্ভব নয়। প্রগতিপ্রয়াসী সংগঠন ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারলে সেটা সম্ভব হবে।
No comments:
Post a Comment