
ইংল্যান্ডে প্রায় ১০ মাস ধরে গৃহবন্দী হয়ে আছি সবাই। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। তাই পড়ালেখা, কাজ—সবকিছুই ঘর থেকে করতে হচ্ছে। আমার বাসায় আমি আর আমার ৬ মাস বয়সী ছোট্ট মেয়েটা ছাড়া সবাই খুব ব্যস্ত। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় ছেলেমেয়েদের অনলাইন ক্লাস। ৯টা থেকে তাদের বাবার অফিস মানে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’! ভাগ্যিস, আমার ম্যাটারনিটি লিভ চলছে। তাই ল্যাপটপে চোখ গেঁথে রাখতে হচ্ছে না।
কিন্তু তাতে কি, অন্যদের অনলাইন কর্মকাণ্ডে আমি আজ নিজ গৃহে পরবাসী!
সকালবেলায় ছেলের রুমে আস্তে নক করে ঢুকে দেখি সে ডেস্কে বসে কানে বিশাল হেডফোন লাগিয়ে লেকচার শুনছে। আমি পেছন থেকে পা টিপে টিপে এসে তার টেবিলে দুধ রাখতেই সে বলে উঠল,
—there is no point in tip toeing মা!!
মাইক্রোফোন বন্ধ কিন্তু ক্যামেরা অন আছে। তোমাকে ক্লাসের সবাই দেখতে পাচ্ছে মা!
শুনে নিজের আলুথালু বেশের দিকে তাকিয়ে প্রায় দৌড়ে রুম থেকে বের হলাম! বদ ছেলেটা আগে বলবে তো ক্যামেরা অন! তাহলে ভালো জামাকাপড় পরে, চুল আঁচড়ে যেতাম!
যওসব!
এরপর গেলাম মেয়ের রুমে। মেয়ে আমার লক্ষ্মী। খুব পরিপাটি হয়ে অনলাইন ক্লাস করে। আর মাইক্রোফোন বন্ধ রাখে। ওর কাছে যাওয়াটা নিরাপদ।
রুমে ঢোকার আগেই সুর করে বলতে বলতে ঢুকলাম,
—ওরে আমার টুনটুন, ঝুনঝুন! নাশতা কি দেব মা?
মেয়ে মাথা ঘুরিয়ে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
—মা!
It’s so embarrassing!! Microphone was on and I was doing a presentation. সবাই তোমার কথা শুনতে পেল!
ও মোর খোদা।
আমি কি জানতাম নাকি? যাহ, আর কারও ঘরেই আর যাব না।
নিজের রুমে এসে দেখি ছোট্ট পাখি উঠে হাত–পা ছড়িয়ে কাঁদছে। পাশের ঘরে তার বাবা ট্যাক্স অফিসে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বেরিয়ে হাত ইশারা করছে, ‘মেয়েকে থামাও!’
কী আর করব! আমি আর আমার ছোট্ট ময়না, বাসার দুই বেকার সদস্য মনের দুঃখে নিচে চলে এলাম। অথচ আমি ম্যাটারনিটি লিভে আছি। আমার ২৪ ঘণ্টা বাসায় থাকার কথা। ওদের নয়!

লন্ডনের কাঠের বাড়িঘর। ওপরতলায় জোরে শব্দ করে হাঁচি দিলে নিচে লিভিং রুমে শোনা যায়। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে যখন বেসুরো গলায় নার্সারি রাইমস বলে ঘুম পাড়াই, তখন অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাহেব কোনো না কোনো ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলেন। আমার ধারণা, ক্লায়েন্টরা জেনে গেছে যে এই বাসায় আধা পাগল টাইপ কোনো মহিলা আছে যে সারাক্ষণ আবোলতাবোল গান করে! গানের গলাটাও যদি একটু ভালো হতো!
একদিন দেখি মেয়ে আমার সিঁড়ি বেয়ে উঠছে আর নামছে। কেন জিজ্ঞেস করতে বলল, পি ই ক্লাস। স্যার বলেছে ১০ বার সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে!
হায় রে বন্দিজীবন!
এখন হাসপাতাল ছাড়া ডাক্তারদের দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ভাগ্য ভালো থাকলে অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায়। পেটে হঠাৎ ব্যথা হওয়ায় অনেক কস্টে ভিডিও কলের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম। ভালো জামা পরে চুল আঁচড়ে ল্যাপটপের সামনে বসলাম। ক্যামেরা অন করতেই নিজেকে দেখে বেশ খুশি হয়ে গেলাম। বাহ, ভালো লাগছে তো। কত দিন পর এতক্ষণ ধরে নিজেকে দেখলাম।
বেবী হওয়ার পর সময় কোথায় আয়না দেখার?
আমার ডাক্তারের কণ্ঠ শোনা গেল!
—হ্যালো! আমি তোমাকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছ?
আমি খুশি হয়ে বললাম,
—হ্যাঁ, আমিও আমাকে দেখতে পাচ্ছি।
ডক্টর বললেন,
—আমি কীভাবে সাহায্য করব?
আমি বললাম,
—পেটে ব্যথা।
ডক্টর বললেন,
—কোথায় ব্যথা আমাকে দেখাও।
এবার আমি পড়লাম বিপদে। ক্যামেরায় আমার পেট দেখাতে হবে, ভাবিনি। বলা বাহুল্য আমার ডক্টর মহিলা নন।
বললাম,
—আমি ক্যামেরায় দেখাতে চাচ্ছি না।
উনি বললেন,
—চেম্বারে আসলে দেখাতে, তাই না! আচ্ছ, তোমার ড্রেসের ওপর দিয়ে দেখাও।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন। ডক্টর কিছু পেইন কিলার দিয়ে কল শেষ করলেন। কী আজব মুসিবতের দিন শুরু হলো আজকাল!
গত এক বছর কোথাও যাওয়া হয়নি, কেউ আসেওনি আমার বাসায়। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী সব এল আবার চলেও গেল। বাচ্চাদের সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় না পরে পরে লম্বায় ছোট হয়ে গেল আর আমার ড্রেসগুলো পাশে!
আমার মেয়ের সবচেয়ে প্রিয় স্কটিশ বান্ধবীর মা ফোন করে তার মেয়ের জন্মদিনের দাওয়াত দিল। জুম বার্থ ডে পার্টি! আমাকে মিটিংয়ের পাসওয়ার্ড দিয়ে বলল,
—রোববার বেলা ২টা। ওরা লাঞ্চ করবে একসঙ্গে। তারপর পার্টি গেমস, তারপর কেক কাটবে। দেরি করো না।
আমি মিনমিন করে বললাম,
—একসঙ্গে খাবার কী করে খাবে?
মনে ক্ষীণ আশা! যদি কিছু পার্টি ফুড সদর দরজায় রেখে যায়!
সে আশার গুড়ে বালি দিয়ে বান্ধবীর মা বলল,
—স্কটল্যান্ড থেকে আমার মেয়ের কাজিনরা জয়েন করবে। ভেবেছিলাম সবাইকে কেক দেব কিন্তু স্কটল্যান্ডে আজকে কেক দিয়ে আসা সম্ভব না। তাই কাউকেই দেব না ঠিক করেছি। তবে পার্টির পর পার্টি ব্যাগ গেটের সামনে রেখে যাব।
আমি বললাম,
—ওর উপহার আমি তোমার দরজার সামনে রেখে আসব!
আমার মেয়ে খুব খুশি হয়ে নতুন জামা পরে কাবাব রোল নিয়ে বার্থডে পার্টিতে যোগ দিল। অনেক অনেক দিন পর! ‘খাবার যার যার পার্টি সবার’ অবস্থা!
আজকাল সব চ্যানেল দেখতে ভালো লাগে না। তাই নিজেদের পছন্দমতো ইউটিউব আর নেটফ্লিক্স দেখি। তা–ও বাসার যে যার সময়মতো, পছন্দমতো প্রোগ্রাম দেখে। আমার সঙ্গে আমার মেয়ের টিভি দেখা নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হয় দেখে তাদের বাবা অশান্তি মেটানোর জন্য আরেকটা টিভি কিনে দিল। বলল,
—এবার যার যা পছন্দ দেখো!
লাভের মধ্যে লাভ হলো আগে একটা টিভিতে ‘ফাইভ লিটিল মাংকি’ গান শুনতাম। এখন দুইটা টিভিতেই একই দিনে একই গান কমপক্ষে এক শ বার শুনতে হয়! কারণ, ছোট্ট বেবি এখন টিভি দেখতে শিখেছে। অন্য কিছু দেখলে কাঁদে!

বাচ্চাদের বাবার করোনা পজিটিভ হওয়ায় ১০ দিন ‘সেলফ আইসোলেশনে’ ছিলাম। বাজারসদাই দূরে থাক, ঘর থেকে বের হওয়ায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা আমাদের সবার। তাই নিরুপায় হয়ে সুপারমার্কেট, অনলাইন শপিং করতে হলো! ৪৫ মিনিট ধরে ৬৪টি আইটেম ভেবেচিন্তে শপিং বাস্কেটে অ্যাড করে চেকআউটের পর হঠাৎ মেসেজ...Your page can not be found! নিজের চুল নিজে টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল!
হঠাৎ করে যখন–তখন ওয়াই–ফাই চলে যায়। ক্লাস, কাজ, টিভি...বেচারা এত লোড নিতে পারে না। বাসায় তখন বিভিন্ন রুম থেকে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার ছেলেমেয়েদের মতো সবাই বের হয়ে আসে। আমার তখন ছোটবেলায় ঢাকায় ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। পড়ার মধ্যে কারেন্ট গেলে কী যে খুশি হতাম! সেদিনের জন্য পড়তে হতো না। কিন্তু এখন ওয়াই–ফাই গেলে বাচ্চারা খুবই বিরক্ত হয়।
সত্যি বলতে কি, ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে ফ্যান বন্ধ হয়ে দেশে যেমন গরম লাগত, আমার তেমন গরম লাগে! ঘামতে শুরু করি!
মাঝেমধ্যে বসে ভাবি, কবে আবার নিজের বাসায় নিজের মতো করে চিৎকার করে বেসুরা গলায় গান গাইতে পারব, পার্টিতে নতুন শাড়ি পরে যেতে পারব! বন্ধুদের সঙ্গে ফেস টাইম না, মুখোমুখি বসে আড্ডা দিতে পারব! এই ‘ওয়াই–ফাই’ মহাশয় একটু বিশ্রাম পাবে আর আমরা আগের জীবনে ফিরব! আহা রে!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকলে আমাদের অনলাইন দিনগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিখতেন— ‘সেই যে আমার নানা রঙের ‘অফলাইনের’ দিনগুলো!’
* লেখক: শায়লা শারমীন, ইংল্যান্ড