GOLPO
মাছের মুড়ো
বসু পরিবারের ইতিহাসে সূচনা হল এক নতুন অধ্যায়ের। নতুন আসন পেতে, বড় কাঁসার বগি থালায়, থরে থরে খাবার সাজিয়ে মাকে সামনে বসে খাওয়াল তার ছেলে, বউ, মেয়ে, জামাইরা।
-সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় / Date : Monday, October 05 , 2020
উত্তর কলকাতার এক বর্ধিষ্ণু যৌথ পরিবারে বিয়ে হয়ে এসেছিল সরমা। সে আজ প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। বাড়ি তখন শ্বশুর, শাশুড়ি, খুড়শ্বশুর, খুড়শাশুড়ি, দেওর, জা, ননদে ভরভরন্ত। বাড়ির বড় বউ হয়ে আসায় অনেক দায়িত্ব চাপে সরমার উপরে। যেমন, সবাইকে সকালের চা দেওয়া, জলখাবার বানানোয় মানদা, মানে বাড়ির রাঁধুনিকে সাহায্য করা, নিজে হাতে সকলকে জলখাবার ও দুপুরের খাবার পরিবেশন করা ইত্যাদি। এছাড়াও মাঝে মাঝেই শ্বশুরমশাইয়ের অনুরোধ অনুসারে রান্না করতে হত তাকে। শাশুড়ি মা বলে দিয়েছিলেন সবার সামনে, ‘‘এখন বাড়ির বড় বউ এসে গেছে, এবার হেঁশেল থেকে আমার ছুটি।’’ সেই থেকে হেঁশেলের তদারকি থেকে শুরু করে, সবার পছন্দ অপছন্দ বুঝে রান্না করা, সবটাই সরমার কাঁধে। কতটুকুই বা তখন বয়স ছিল তার! সবে স্কুল ফাইনাল পাস করে গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিল মা-বাবার সঙ্গে। সেখানকার জমিদারবাবুর বন্ধু ছিলেন সরমার শ্বশুরমশাই অম্বরীশবাবু। তিনিও সেই সময় ওই গ্রামেই গিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু অর্থাৎ জমিদারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। এক বিকেলে নদীর ধারে সরমা তার বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে এক্কা-দোক্কা খেলছিল। সেই সময় জমিদারবাবুর সঙ্গে অম্বরীশবাবু নদীর ধারে হওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন। সরমাকে দেখে তাঁর খুব ভাল লাগে। তিনি সেই সময়ে তাঁর বড় ছেলের বিয়ে দেবেন বলে একটি সুলক্ষণা মেয়ের সন্ধান করছিলেন। খোঁজ খবর করে জানতে পারেন, ওই মেয়ে তাঁদের পাল্টি ঘর এবং তার পরিবারও যথেষ্ট শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত। তাই কালবিলম্ব না করে সরমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সরমার বাড়িতে একটুও আপত্তি জাগেনি। এত ভাল বংশের ছেলের সঙ্গে তাদের মেয়ের বিয়ে হবে জেনে সরমার মা-বাবা যেন হাতে চাঁদ পেলেন। আসলে সরমার পরে আরও তিনটি বোন এবং দুটি ভাই ছিল। সংসারের চাপে মেয়ের আরও শিক্ষিত হওয়ার বাসনা নতি স্বীকার করে। সরমার বিয়ে হয়ে যায় উত্তর কলকাতার বিখ্যাত বসু পরিবারে।
সেই থেকে ষোড়শী সরমা, হয়ে গেল বসু বাড়ির বড় বউ। সরমার স্বামী অনাদিবাবু অত্যন্ত ভালমানুষ ছিলেন। তিনি নিজের ব্যবসা সামলে আর বাড়ির জন্যে বিশেষ সময় বের করতে পারতেন না। তবে সরমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। বয়সে সরমা তাঁর চেয়ে প্রায় বারো বছরের ছোট ছিল কিনা! কালের নিয়মে দিন কেটে যায়। সরমার কোল আলো করে পরপর এল তার তিন ছেলে আর দুই মেয়ে। ননদদের একে একে বিয়ে হয়ে গেল। দেওরদের বিয়ে হল। এল তার দুই জা। কিন্তু হেঁশেলের দায়িত্ব শাশুড়িমা আর কাউকে দিতে চাইলেন না। ওটা সরমারই দায়িত্বে থেকে গেল চিরকাল। সে যে বড় ভাল রান্না করতে শিখে গিয়েছিল! সবাই তার রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করত। শ্বশুরমশাই বেঁচে থাকতে শাশুড়িমা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, রোজ খাবার পরিবেশনের সময় বড় মুড়োটা যেন সবসময় ওঁর পাতেই দেওয়া হয়। মাছের বাকি বড় টুকরোগুলো বাড়ির ছেলেদের জন্যে বাটিতে বাটিতে তুলে রাখত সরমা। তারপর শাশুড়ি আর ননদদের মাছ তুলে রেখে, সব শেষে, সবচেয়ে ছোট টুকরোটা থাকত সরমার জন্যে। বাড়ির বড় বউকে এরকমই শিক্ষা দিয়েছিলেন তার শাশুড়িমা।
এভাবে বাড়ির বড় বউ হয়ে, এক গলা ঘোমটা দিয়ে, শ্বশুরবাড়ির সব নিয়মের পালন করে, সকলের রসনার তৃপ্তিসাধন করে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছে সরমা। কেউ কখনও তার মনের খবর রাখেনি। এখন তার বয়স ছাপ্পান্ন। শ্বশুর, শাশুড়ি একে একে গত হয়েছেন। এখন বাড়িতে লোক বলতে, সরমা, তার স্বামী অনাদিবাবু, আর তাদের ছেলেরা। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে ভাল পরিবারে। জামাইরা বাড়িতে এলে এখনও এক গলা ঘোমটা টেনে বড় মুড়ো পরিবেশন করে সরমা।
এহেন সরমার জীবনে ঘটে গেল একটি দুর্ঘটনা। সরমার এক দেওরের ছেলের যখন বিয়ে হল, এটা তখনকার কথা। বাড়িতে যেদিন বউ এল, সেদিনই বরণ করতে যাওয়ার তাড়াহুড়োয় শাড়িতে পা জড়িয়ে গিয়ে দোতলার সিঁড়ি থেকে নীচে গড়িয়ে পড়ে সরমা। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় তাকে। মাথায় গভীর চোট লেগেছিল তার। অপারেশন করেও ভাল কিছু ফল পাওয়া গেল না। সরমা মানসিক ভারসাম্য কিছুটা হারিয়ে ফেলল। দিন যায়। সবাই নিজের নিজের মতো করে জীবনযাপন করে চলে। সংসার কারও জন্য থমকে থাকে না। শুধু সরমার জীবন থেকে যেন কেউ সমস্ত গতি কেড়ে নিয়েছে। তার দিনগুলো থমকে গিয়েছে হঠাৎ করে খাট, বিছানা, আলমারি, আলনার ফাঁকে। রান্নাঘর, হাতা-খুন্তির শব্দ, ফোড়নের গন্ধ, শিল-নোড়ায় মশলা বাটার শব্দ... সব যেন এক ঝটকায় মিলিয়ে গিয়েছে তার জীবন থেকে। এখন সরমা খাটের উপর বসে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে বাইরে চেয়ে থাকে। হাবেভাবে সে যেন এক ছোট্ট মেয়ে। তার নাতি নাতনিরা সামনে গেলে তাদের বলে, ‘‘এই লাট্টু খেলবি? আমি খুব ভাল লাট্টু ঘোরাতে পারি।’’ কখনও বলে, ‘‘ওই ঘুড়িটা ধরে আনতে পারবি? তাহলে তোদের কুলের আচার খাওয়াব। আমার ঠাকমা খুব মিষ্টি কুলের আচার বানিয়েছে।’’ ওরা অবাক চোখে নিজের ঠাকুমাকে দেখে। একদিন সরমা তার ছোট নাতিকে বলল, ‘‘চল না, ওই পাশের বাড়ির আমগাছ থেকে আম চুরি করে আনি!’’ একদিন তো দুপুরে সবার অলক্ষ্যে বেরিয়েই পড়েছিল বাড়ি থেকে। আমগাছের কাছে তাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে পাড়ার এক বউ ধরে ধরে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে। বাড়ির সবাই এখন ভয়ে ভয়ে থাকে, কখন কী কাণ্ড না বাঁধে! এভাবে ভালয় মন্দে দিন কেটে যাচ্ছিল। গোল বাধল এক জামাইষষ্ঠীর দিনে। সেদিন, সরমার মেয়ে জামাই নাতি নাতনিতে ঘর ভরা। অনাদিবাবু আর ছেলেরা অনেক বাজার করে এনেছেন। এবাড়ির জামাইষষ্ঠীর পরম্পরা তো সরমার অসুখের জন্যে থেমে থাকতে পারে না! সরমার ছেলের বউরা রান্নায় ব্যস্ত। অনাদিবাবু বলে দিয়েছেন, ভাত, ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, পার্শে মাছ ভাজা, পাবদা-সর্ষে, কাতলা কালিয়া, ভেটকি পাতুরি, পাঁঠার মাংস, আমের চাটনি আর দই মিষ্টি হবে আজকের মেনু। আর দুই জামাইয়ের জন্যে তিনি আলাদা করে বড় কাতলার মুড়ো এনেছেন, যা তাদের প্রতি বছর খাওয়ানোর রীতি বসু পরিবারে প্রচলিত। ছোট জামাই একটু আধুনিক মনস্ক। সে আবার এতসব খেতেও পারে না, খেতে চায়ও না। কিন্তু বউয়ের ভয়ে কিছু বলতে পারে না। দুপুরের মধ্যে সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ। সারা বাড়ি খাবারের সুঘ্রাণে ম ম করছে। জামাইদের জন্যে বিশেষ আসন পেতে, বড় কাঁসার বগি থালায় করে থরে থরে সাজানো হয়েছে সুস্বাদু সব খাবার। জামাইদের পাশে অনাদিবাবু ও তাঁর ছেলেদেরও আসন পেতে খেতে বসানো হয়েছে। তাদের সামনেও কাঁসার থালায় খাবার সাজানো। আজ সরমা অনুপস্থিত বলে অনাদিবাবুর ছেলের বউরা খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে। এই প্রথম শাশুড়ির দায়িত্ব পালন করছে তার পুত্রবধূরা। সবে শাঁখ বাজানো হয়েছে, জামাইরা এবং বাকি সবাই খাবারে হাত দিতে যাবেন, সরমা আলুথালু বেশে উদয় হল খাবার ঘরে। এসেই ঘোষণা করলো, ‘‘আজ বড় মুড়োটা কিন্তু আমি খাব। ওটা আমাকে দিস।’’ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল ঘরের মধ্যে। কোথাও একটা পিন পড়লেও শব্দ শোনা যেত। সকলে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সরমার মুখের দিকে। সে মুখে আনন্দ ছাড়া কোনও অভিব্যক্তি নেই। শিশুর মতো সরল একটি নিষ্পাপ মুখ। লুব্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বড় মুড়োগুলোর দিকে। অনাদিবাবু অত্যন্ত বিরক্তি সহকারে মেয়েদের উদ্দেশে বললেন, ‘‘দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? ওকে নিয়ে যা নিজের ঘরে!’’ মেয়েরাও স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বুঝেই উঠতে পারছিল না, কী করা উচিত। বাবার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, ‘‘হ্যাঁ বাবা, এই যাই।’’ মায়ের এই অদ্ভুত ব্যবহারে তারাও লজ্জিত বোধ করে। সরমাকে হাত ধরে টানতেই সে বলে ওঠে, ‘‘আমার অনেকদিনের সাধ, জানিস, ওই বড় মুড়ো খাওয়ার। কোনওদিন কেউ আমাকে খাওয়ায়নি রে। আমার খুব কষ্ট হত, কেউ বুঝত না। তোরা আমাকে খাওয়াবি ওই বড় মুড়ো?’’ মেয়েরা কী বলবে ভেবে পায় না। অনাদিবাবু বললেন, ‘‘ছি ছি, কী কেলেঙ্কারি দেখো দেখি! জামাইদের খাবারে কিনা শাশুড়ি নজর দেয়! লজ্জায় মাথা কাটা গেল আমাদের।’’ জামাইদের দিকে চেয়ে বলল, ‘‘বাবারা, তোমরা কিছু মনে কোরো না, জানোই তো তোমাদের শাশুড়িমায়ের মাথার ঠিক নেই। ওকে এখনই আমি ঘরে দিয়ে আসছি। তোমরা খাওয়া শুরু করো।’’ অনাদিবাবু উঠতে যাবেন, এমন সময় ছোট জামাই বলে উঠল, ‘‘আমার একটা কথা ছিল বাবা। আমি যদিও সবার চেয়ে ছোট, তাও আর চুপ করে থাকা সমীচীন বোধ করছি না। তাই বাধ্য হয়ে বলছি। মাকে আপনি এখান থেকে কোথাও নিয়ে যাবেন না। উনি আজ এখানে বসেই খাবার খাবেন।’’ এমন অদ্ভুত কথায় সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। বসু পরিবারের ইতিহাসে এমন কথা কেউ কখনও শোনেনি যে শাশুড়ি তার জামাইদের সঙ্গে বসে খাবার খেয়েছেন, তাও আবার জামাইষষ্ঠীর দিনে! অনাদিবাবু বললেন, ‘‘এটা তুমি কী বলছ বাবা? এ আবার হয় নাকি! লোকে শুনলে কী বলবে?’’ জামাই বলে, ‘‘কেন হবে না বাবা? এটা তো সম্পূর্ণ আমাদের পরিবারের ব্যাপার। এখানে কীভাবে কী হবে, সেটা অন্য কেউ কেন নির্ধারণ করে দেবে? সারাজীবন আমরা লোকে কী বলবে, লোকে কী ভাববে, এই করে করে নিজেদের মনের সমস্ত বাসনাগুলোর বলিদান দিয়ে যাই। আমরা কেউ কি কখনও মায়ের কথাটা একবারও ভাবছি? ওই মানুষটা, কত ছোট বয়সে এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন। আপনার মেয়ের মুখে আমি সব গল্প শুনেছি, কীভাবে বাড়ির বড় বউ হিসেবে সমস্ত পরিবারটিকে ধরে রেখেছিলেন মা। তাঁর এ সংসারের জন্যে যে আত্মত্যাগ, তার কি মূল্য আমরা দিতে পেরেছি? কখনও কেউ তার মনটাকে বোঝার চেষ্টা করেছে? তারও তো কিছু সুপ্ত বাসনা থেকে গেছে মনের অতলে, যার সন্ধান তার নিজের স্বামী বা সন্তানরাও রাখেনি!’’ সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। কোথাও একটা পাতা পড়ার শব্দ নেই। ছোট জামাই বলে ওঠে, ‘‘আমার মনে হয়, আজকের দিনে আমাদের উচিত, ওঁকে ওনার যথাযথ মর্যাদায়, সবার মাঝে বসিয়ে যত্ন করে খাওয়ানো।’’
আবার নীরবতা। এমন সময় উঠে দাঁড়াল বড় জামাই। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল শাশুড়ি মায়ের দিকে। সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘আসুন মা, আপনি আজ সবার সঙ্গে বসে খাবেন।’’ অনাদিবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘এ হয় না, হতে পারে না!’’ তার দুই পুত্রবধূ তখন শাশুড়ির পাশে এসে দাঁড়াল। এই প্রথম শ্বশুরমশাইয়ের সামনে মুখ খুলল তারা। ‘‘আমরাও কিন্তু মায়ের পাশেই আছি বাবা। একটু ওঁর অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুন।’’ অবশেষে ছেলে মেয়েরাও মায়ের পক্ষ নিলে অনাদিবাবু উপায়ন্তর না দেখে রাজি হলেন।
বসু পরিবারের ইতিহাসে সূচনা হল এক নতুন অধ্যায়ের। নতুন আসন পেতে, বড় কাঁসার বগি থালায়, থরে থরে খাবার সাজিয়ে মাকে সামনে বসে খাওয়াল তার ছেলে, বউ, মেয়ে, জামাইরা। বিশেষ করে খাওয়ানো হল বড় মাছের মুড়োটা। সরমার মনের সব সুপ্ত বাসনা যেন নিষ্ক্রমণের পথ পেল। আজ শিশুসুলভ সরলতায়, বড় মাছের মুড়োয় কামড় বসাল বসু বাড়ির বড় বউ। সাক্ষী রইল এই বাড়ি আর বাড়ির লোকেরা।
অলংকরণ: বৈশালী সরকার
No comments:
Post a Comment