১০/১১/২০২০
খুবই ইন্সপিরেশনাল একটা জীবনের গল্প । আমি সবসময় বিশ্বাস করি, যে ভালো সে ভালোই হবে। পৃথিবীর কোন কিছুই তাকে খারাপ করতে পারবে না। আর যে খারাপ, সে খারাপই হবে। পৃথিবীর কোন কিছুই তাকে ভালো করতে পারবে না।
------------------ ------------------ ------------------
আলহামদুলিল্লাহ! 

পারিবারিক অভাব অনটনে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার পরিস্থিতি থেকে আজ একজন ব্যাংক কর্মকর্তা হয়েছি। কোথায় ছিলাম কোথায় আসলাম। 



চোট্ট একটা চাকরি - পুরো আত্মতৃপ্তি।
১। প্রাথমিকঃ
কত রাত না খেয়ে ঘুমাইছি তার হিসাব নাই। সহজ সরল দিনমজুর বাবার অপারগতার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই, আছে তার পরিশ্রমের প্রতি সম্মান- এক বুক ভালবাসা।
দাদা, আমার বাবা কে প্রায়ই বলত, ৩০ টাকা আর সোয়া সের চালে তোরই দিন চলে না, তোর বউ বাচ্চা খাবে কি! আসলে ২০০২-০৫ এর দিকে সারাদিন হাজিড়া খেটে ৩০ টাকা আর সোয়া সের চাল পেত। এটা দিয়ে আমাদের সংসার চলত। এ সময়ে, স্কুল চলাকালীন কোন দিন দুপুরে খাইছি কিনা মনে পরে না। হাটে গরুর দুধ বিক্রি করা, আর বাঁশ কঞ্চি কাঠ কুড়িয়ে খড়ি বিক্রি করাই প্রধান কাজ ছিল আমার। মুরগী পালন টা অবশ্য আমি ক্লাস টু থেকেই শুরু করেছিলাম। 

২। মাধ্যমিকঃ
সাইকেল বই খাতা কলম কেনার টাকা ছিল না, এ সময়ে পড়ালেখা বাদ দেয়ার পরিকল্পনাও ছিল। মুরগী বিক্রি করে যা পাইতাম তা দিয়েই সাহস করে স্কুলে ভর্তি হই। বন্ধুদের সাইকেল অদল বদল চালিয়ে স্কুল করতাম। 

পরে অবশ্য একটা পুরাতন সাইকেল কিনছিলাম খগেনদার ধান আর বাদাম খেতের চুক্তি কাজ করে।
নদী পারাপারের খেয়া ঘাট ইজারা নিতাম আমরা, নৌকায় রাত ১২ টা পর্যন্ত থাকতাম। ইঁদুরের গর্ত খুড়ে ধান বের করা, কামলা দেয়া, গরুর ঘাস কাটাই প্রধান কাজ ছিল এই ধাপে।

এ সময় আমার মুরগী পালন ভেড়া পালনে পরিনত হয়।
মুরগী আর ভেড়া থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়েই টেনে টুনে পড়ালেখা চলে।

এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই অতিথি পাখির মত টাংগাইলে উড়াল দেই। 

৩। উচ্চ মাধ্যমিকঃ
কলেজে ভর্তি আর বই কিনতে অনেক টাকা দরকার।
এই চিন্তা মাথায় ঢুকে এসএসসি রেজাল্ট দেয়ার আগেই।

তাই টাকা উপার্জনের জন্য গ্রীষ্মের দাবদাহ রোদে ধান কাটতে টাংগাইলে যাই। সারা রাত ট্রাকে জার্নি করে ঘাটাইলে যেয়ে সকালে বাজারে উঠি। 



এই বাজার কাচা বাজার নয় মশাই, এটা মানুষ বিক্রির বাজার 

সারাদিন কাজ করার চুক্তি হয় হাটে। একজন গৃহস্থ মালিক আমাদের নিয়ে গেল। নির্ঘুম সারারাত, দিনে ঢুলেঢুলে ধান কাটলাম আর আটি বোঝা নিয়ে আইল বেয়ে মালিকের বাড়ি পৌছানির কাজ। 

দিন শেষে ১৮০ টাকা দিয়ে বিদায়।
আবার বাজারে গেলাম। বাজারে কোন এক দোকানের নিচে কাথা বিছায়ে ঘুমাইছি। মনে নাই 

পরের দিন সকালে উঠে আবার বাজারে দাঁড়িয়ে যাই, বিক্রি হবো বলে, এভাবে ১ মাস কাজ করি। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের রোদে রক্তপ্রস্রাব হত। বড় বড় কামলারা কেউই ২০ দিন টানা কাজ করতে পারে না। সেখানে আমি এক মাস কাজ করি। 



শেষ যেদিন মালিকের বাড়িতে কাজ করি, ১৫ মে, আমার এসএসসি রেজাল্ট দেয়, চাচাতো ভাই ফোন করে বলে ভাই প্লাস পাইছো। প্লাস দিয়া কি করবা? 



রেজাল্ট শুনে আমার শরীর কাঁপতেছিল। 


মালিক আমার রেজাল্ট শুনে বলছিল,
আমার বাড়ির কামলা পায় এ প্লাস, এটা আমার সৌভাগ্য। মিষ্টি আমিই খাওয়াবো সবাই কে।
পরে উনিই সবাইকে মিষ্টি খাওয়ায়। আর আমাকে কাজ করতে নিষেধ করে 



এর পর শুরু হয় কলেজ জীবন, সাইন্সের ছাত্র হয়ে সপ্তাহে ৬ দিন, ৪ টা করে টিউশন করতাম। 
আমার ভেড়া গুলো বিক্রি করে বোনের বিয়েতে বাবা কে সাহায্য করেছিলাম। 



ইন্টারমিডিয়েটে অনেক কষ্টের ফল স্বরুপ জিপিএ ৫ পাই
।

৪। বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
কোন কোচিং ছাড়াই ৬ টা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ৩ টা তে চাঞ্চ পাই। 

নিজের অবস্থান বুঝে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই 



এর পর শুরু হয় আবার টিউশন যুদ্ধ। ৪-৫ টা টিউশন প্রতি মাসেই করতাম।
সকালে ৮ থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত ক্লাস করে সাইকেল নিয়ে টিউশন যেতাম, আসতে আসতে রাত ১১ টা - ১১ঃ৩০ টা বেঁজে যেত। 
এ সময়ে আমার অনেক গুলো গরু ছিল। যা বিক্রি করে ছোট বোনকে বিয়ে দেই। 





টিউশনের টাকা থেকে, বাড়ির ভিটার সাথে বাবার অল্প একটু জমিতে প্রথমে তেজপাতা বাগান করে দেই। 

এর পর আম বাগান, যত্নের অভাবে তেমন লাভ না হওয়ায় আম বাগান উঠায় লেবু বাগান করে দেই। তাই দিয়ে বাবা আমার সংসার টানে। 

এখন সেই জমিতেই সুপারি বাগান করে দিচ্ছি। যাতে অন্যের বাড়িতে বাবা কে কাজ না করতে হয়। বাবা প্রতিবছর দুই ঋতুতে টাংগাইলে কাজ করতে যেত। তার এই টাংগাইলে যাওয়া বন্ধ করে দিছি ২০১৪ তেই।

তবে সংসার টানতে কিছুদিন আগেও নিজ এলাকায় ধান ও বাদামের সময়ে হাজিরা ও চুক্তিকাজ করেছে। 



এইত সময় এখন আমার হাতে 



ছোট ভাই বোনদের ঈদের কেনাকাটা ও মা-বাবার ঔষধ যোগান দেয়া আমার অন্যতম একটা দায়িত্ব 

আহা সেই সব স্মৃতি এখনো জীবিত। 



সব কথা বলে শেষ করা যাবে না। আইচ্ছা 

আলহামদুলিল্লাহ সব কিছুর জন্য।
উল্লেখ্য,
আমার ৪ দাদা ও নানার বংশে আপাতত একমাত্র আমিই মাস্টার্স পাশ এবং একজন অফিসার।
তাহলে বুঝুন মশাই কত কষ্ট করেছি জীবনে। আমার পথটা এত সহজ ছিল না। 

তবে আরো ভাল কিছু করতে সবার দুয়া চাই।





কৃতজ্ঞতা বাবা-মা, প্রিয় শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি। 



Md. Abdul Gofur এর ওয়াল থেকে সংগৃহিত, মূল পোস্ট লিংক কমেন্টে।
No comments:
Post a Comment