Tuesday, December 15, 2020

 

তোমাদের যা বলার ছিলো, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

    ইসলামের জন্মভূমি সৌদি আরবে যখন নারীরা ক্রমশ এগিয়ে আসছে, গাড়ি চালানোর অনুমতি পাচ্ছে; তখন বাংলাদেশের মৌলবাদীরা নারীদের ‘ফোর-ফাইভ’ পর্যন্ত পড়াতে চায়, কাজ করতে দিতে চায় না। 

ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতা করে মৌলবাদীরা মুসলমানদের পিছিয়ে দিয়েছিল। এখনও কথায় কথায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তারা সব মানুষের ধর্ম ইসলামকে গণ্ডিবদ্ধ করে রাখতে চায়। সহজ ইসলামকে কঠিন করে ফেলতে চায়। অল্প কিছু মৌলবাদীই যেন ইসলামকে লিজ নিয়ে ফেলেছে। তারা কথায় কথায় হারাম-হালালের তালিকা দেয়, আবার মাঝে মাঝেই সেই তালিকা বদলায়, যখন ইচ্ছা যাকে তাকে অমুসলিম, কাফের, নাস্তিক ঘোষণা করে।

বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। তারা নিয়মিত ধর্ম পালন করে। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, টাকা জমিয়ে শেষজীবনে একবার হজ করা, মানুষের কল্যাণ করাকেই ধর্ম হিসেবে পালন করে। কিন্তু কাঠমোল্লারা এই সহজ ইসলামকে নানান নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকে রাখতে চায়। তাদের দৃষ্টিতে ভাস্কর্য হারাম, সুদ হারাম, ছবি তোলা হারাম, ছবি দেখা হারাম, সিনেমা হারাম, গান হারাম, ফেসবুক হারাম, নারীশিক্ষা হারাম, নারী নেতৃত্ব হারাম। তাদের কথা না মানলে ইসলাম ধর্ম অপালনযোগ্য হয়ে যাবে। প্রতিযোগিতামূলক কঠিন বিশ্বে মুসলমানরা আরও পিছিয়ে পড়বে। সময় এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের। শ্রেষ্ঠ হতে হলে সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদীরা যে ভাষায়, যে ভঙ্গিতে কথা বলে, সারাক্ষণ ঘৃণা ছড়ায়, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায়, সমাজে অশান্তি ছড়ায় তা ইসলামসম্মত নয়। ইসলামের শান্ত সুফি ভাবধারার সাথে এই কাঠমোল্লাদের ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম বিশ্বজয় করেছিল শান্তির বাণী দিয়ে, ঘৃণা বা সন্ত্রাস দিয়ে নয়। আজ যারা শান্তির ধর্ম ইসলামকে সন্ত্রাস আর জঙ্গীবাদের ধর্ম বানাতে চায়, তারা অবশ্যই ইসলামের শত্রু।

গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স বা বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের যৌথভাবে প্রকাশিত সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে- ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে বাংলাদেশ। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান এই নিউজটি শেয়ার করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দেশ অশিক্ষিত মোল্লা-মৌলভীতে ভরে গেলে এই তো হয়।‘ অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক আর সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ যখন বিশ্বের বিস্ময়; তখন জ্ঞান সূচকের এই হাল আমাদের জন্য লজ্জাজনক। এই অন্ধকারের শক্তির কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে হবে।

একাত্তরে সব ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। একাত্তরের স্লোগান ছিলো ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’। একাত্তরের গান ছিলো ‘নেই ভেদাভেদ হেথা চাষা আর চামারে/নেই ভেদাভেদ হেথা কুলি আর কামারে/হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান/আমার এ দেশ সব মানুষের।‘ সব মানুষের এই দেশকে তারা শুধু মুসলমানদের দেশ বানাতে চায়। অথচ ইসলাম সব ধর্মকে সম্মান করাই শেখায়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এলে আসাদ চৌধুরীর কবিতার একটি লাইন প্রশ্ন হয়ে ঘুরে বেরায় আমাদের মাঝে, ‘তোমাদের যা বলার ছিলো, বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ মুক্তিযোদ্ধারা, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা, ৩০ লাখ শহীদ যে স্বপ্নে যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন; আমাদের দায়িত্ব ছিলো সেই বাংলাদেশ গড়ে তোলা- সবার বাংলাদেশ, সব মানুষের বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কেন যেন মনে হয়, এই প্রশ্নের উত্তর হলো, ‘তোমাদের যা বলার ছিলো, বলছে না তা বাংলাদেশ’। আমাদের আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়তে হবে, রুখতে হবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে। তাহলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পাবে।

(লেখক প্রভাস আমিন)

No comments:

Post a Comment