"উয়োক" সংস্কৃতি ও "দ্য বিচ"
---------------
জীবন মানেই দায়, দায়িত্ব, নানা বিধি নিষেধ ও নিয়ম কানুন। যা অনেক সময়ই অপরের ভার বহন ও দায়িত্ব নিতে বাধ্য করে। এটি আমরা তখনই খুশি মনে করতে পারি, যখন আমরা জীবনকে উপভোগ করি এবং নিজেকে ও আপনজনদের ভালবাসি। কিন্তু যারা নিজেকে এবং আপনজনদের ভালবাসে না, জীবনকে ভালবাসে না, জীবন তাদের কাছে শুধুই যন্ত্রণা, ভারবহন ও নীরস দায়িত্বপালন। তারা তখন অপেক্ষা করে থাকে স্বার্গে যাবার। যেখানে তাকে কিছুই করতে হবে না, কোন দায়িত্ব নিতে হবে না এবং সে শুধুই ইন্দ্রিয় আনন্দ উপভোগ করবে।
স্বর্গ বা বেহেশতের ধারণা তাই একটি জীবন বিদ্বেষী ধারণা, যেটা উয়োক মানসিকতা লালন পালন করে থাকে। ধার্মিকদের জন্য যে কেহেশত পরকালের, নাস্তিক বা সুপার লিবারেল আধুনিকদের জন্য সেই বেহেশত হয় একটি ইউটোপিয়ান সমাজ। যেখানে কোনো আইন কানুন, মূল্যবোধ ও প্রথা বিরাজ করে না। তেমনই একটি উয়োক ইউটোপিয়া নিয়ে একটি অসাধারণ সিনেমা আছে যার নাম "দ্য বিচ"।
"দ্য বিচ" একটি ২০০০ সালের আমেরিকান-ব্রিটিশ অ্যাডভেঞ্চার ড্রামা ফিল্ম, যেটি পরিচালনা করেছেন ড্যানি বয়েল। যেটি অ্যালেক্স গারল্যান্ডের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। এতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন লিওনার্ডো ডিক্যাপ্রিও। এই সিনেমার গল্প একটি তরুণ আমেরিকান ভ্রমণকারী রিচার্ডকে ঘিরে আবর্তিত, যে থাইল্যান্ডে একটি গোপন এবং স্বর্গীয় দ্বীপের সন্ধান পায়। সিনেমাটি শুধু একটি রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্পই নয়, বরং এটি "ওয়েক" সংস্কৃতি বা জাগ্রত সংস্কৃতির ভেতর-বাহিরকে প্রতিফলিত করে, যেখানে আধুনিক সমাজের আদর্শবাদ, স্বাধীনতার সন্ধান এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার দ্বন্দ্ব তুলে ধরা হয়েছে।
দ্য বিচের গল্প শুরু হয় যখন রিচার্ড (লিওনার্ডো ডিক্যাপ্রিও), যে একজন আমেরিকান পর্যটক, ব্যাংককের একটি সস্তা হোটেলে থাকার সময় তার সাথে এক উন্মাদ স্কটিশ ব্যক্তি ড্যাফির (রবার্ট কার্লাইল) সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ড্যাফি তাকে একটি রহস্যময় দ্বীপের কথা বলে, যেটি নাকি একটি স্বর্গের মতো জায়গা, যেখানে একটি গোপন সম্প্রদায় বাস করে। ড্যাফি আত্মহত্যা করার আগে রিচার্ডের হাতে একটি মানচিত্র তুলে দেয়। এই মানচিত্র দেখে রিচার্ড সেখানে যেতে উৎসাহিত হয় এবং দুই ফরাসি পর্যটক, এটিয়েন (গুইলিয়াম ক্যানেট) এবং ফ্রাঁসোয়া (ভার্জিনি লেডোয়েন)-এর সঙ্গে সেই দ্বীপের খোঁজে যাত্রা শুরু করে। ফ্রান্সোয়ার প্রতি আকর্ষণই রিচার্ডকে তাদের সংযুক্ত করতে উৎসাহী করে।
তারা দ্বীপে পৌঁছে দেখে সেখানে একটি ছোট সম্প্রদায় বাস করে, যারা আধুনিক সমাজের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃতির মাঝে একটি স্বাধীন, সাম্যবাদী জীবনযাপন করছে। এই সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে আছে সাল (টিল্ডা সুইন্টন), একজন কঠোর এবং আদর্শবাদী নারী। প্রথমে রিচার্ড এই জায়গাটিকে একটি স্বপ্নের মতো মনে করে—সেখানে কোনো নিয়ম-কানুন নেই, সবাই স্বাধীনভাবে বাঁচে, এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকে। এটি "উয়োক" সংস্কৃতির একটি আদর্শ রূপকে প্রতিফলিত করে, যেখানে সামাজিক সমতা, পরিবেশবাদ এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ওই সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে থাকা সাল রিচার্ডকে জরুরী রসদ কিনতে যাবার নামে সাথে নিয়ে নিকটস্থ শহরে আসে এবং তার সাথে যৌন সম্পর্ক করতে বাধ্য করে এবং তাকে হাতে রাখতে চায়।
কিন্তু ধীরে ধীরে সেই আদর্শ বা স্বর্গীয় সমাজের অন্ধকার দিক প্রকাশ পেতে থাকে। সম্প্রদায়ের সদস্যরা, যারা বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে এবং তাদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য যে কোন চরম পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। যখন একজন সদস্য হাঙরের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়, তখন সম্প্রদায় তাকে সাহায্য করার পরিবর্তে মৃত্যুর জন্য সাগর পাড়ে ফেলে দিয়ে আসে, কারণ তার ব্যাথায় গোঙ্গানি ও চীৎকার তাদের অসহ্য লাগে এবং তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চায় না, কারণ এতে তাদের অবস্থান প্রকাশ হয়ে তাদের স্বর্গীয় জীবন শেষ হয়ে যাবে।
এদিকে, রিচার্ড এবং ফ্রাঁসোয়ার মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা সালের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। সম্প্রদায়ের ভেতরে ঈর্ষা, ক্ষমতার লড়াই এবং নৈতিক দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। বাইরে থেকে মাদক চাষীদের হুমকি এলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। রিচার্ড ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে এই তথাকথিত স্বর্গ আসলে একটি মায়া, যেখানে স্বাধীনতা ও সমতার আদর্শ কেবল শব্দে সীমাবদ্ধ; বাস্তবে এটি নিয়ন্ত্রণ, ভয় এবং স্বার্থপরতায় ভরা।
শেষ পর্যন্ত, রিচার্ড এবং তার সঙ্গীরা এই দ্বীপ থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। সিনেমাটি শেষ হয় রিচার্ডের প্রতিফলনের মাধ্যমে, যেখানে সে বোঝে যে সত্যিকারের স্বাধীনতা বা আদর্শ কোনো গোপন দ্বীপে নয়, বরং নিজের ভেতরে খুঁজতে হয়।
"দ্য বিচ" সিনেমাটি "উয়োক" সংস্কৃতির দ্বৈততাকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। একদিকে এটি পরিবেশবাদ, সাম্যবাদ এবং ব্যক্তিগত মুক্তির স্বপ্ন দেখায়, যা আধুনিক জাগ্রত আন্দোলনের মূল বিষয়; অন্যদিকে এটি দেখায় কীভাবে এই আদর্শগুলো বাস্তবে দাঁড় করাতে গিয়ে অমানবিকতা, নিয়ন্ত্রণ এবং স্ববিরোধিতায় রূপ নেয়। এই দ্বীপ সম্প্রদায় যেন "উয়োক" সংস্কৃতির একটি প্রতীক, যেখানে উচ্চ আদর্শের কথা বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে তা ব্যর্থ হয় এবং নিজেরই অন্ধকার দিক প্রকাশ পায়। যখন একজন সদস্য হাঙরের আক্রমণে গুরুতর আহত হয় তখন তাকে সবাই যেন চোখের সামনে থেকে বিদায় করতে চায়। এটি "উয়োক" সংস্কৃতির ভণ্ডামির একটি দিক তুলে ধরে—যেখানে আদর্শের নামে মানবিকতা এবং বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা হয়।
No comments:
Post a Comment