০১.
হামিদ দাঁড়িয়ে আছে জানালার শিক আঁকড়ে। আমার বন্ধু হামিদ। আমার ক্যাপ্টেন হামিদ। যার মাথার জন্য পা'কিস্তানি মিলিটারি সীমান্তের পুরো দু'টি গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল, সেই জল্লাদ হামিদ। যে হামিদ শিস দিতে-দিতে বুটের তলায় পাকিস্তানি সেনাদের মাথা পিষে দিতো, সেই হামিদ। যে হামিদ বেয়নেটে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে রা'জাকারের কণ্ঠনালী ছিঁড়ে দেওয়ার সময় গান গাইতো─ "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি", সেই হামিদ। যে হামিদ যুদ্ধের মাঝপথে এই খবর পেয়েছিল যে, তার মায়ের পেট ফেঁড়ে দিয়েছে পা'কিস্তানি মিলিটারি এবং শুধুমাত্র দুইবার চোখ মুছেছিল হাতের তেলোয় এবং পরক্ষণেই অশ্রুজলে ভাসন্ত আমাদের কমান্ড করেছিল─ "আর একফোঁটা পানি যদি পড়ছে তগো চোখ বায়া, খোদার কসম কইলাম, কইলজা কাঁচা খায়া ফালামু! আমার মা'ডার কষ্ট হয় না তগো কান্দনে?" সেই হামিদ। যে হামিদ আসমানের দিকে তাকিয়ে ঝিম মেরে বসে ছিল শুধুমাত্র দুই মিনিট, এই খবর পেয়ে যে, তার পোয়াতি স্ত্রীর জরায়ু চিরে বের করে ফেলা হয়েছে লাল-গোলাপি একপিণ্ড মাংস। সেই নির্মম হামিদ, দাঁড়িয়ে আছে জানালার শিক আঁকড়ে। স্তব্ধ! অশ্রু টলোমল!
০২.
শুরুতে আমরা ছিলাম বত্রিশ জন। ন'মাস পরে যখন ছয় জনে নেমে এলাম, আমার মা তখন স্বাধীন। আমি, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়েছিলাম হাউমাউ জলে-সুখে! আমরা ছয় জন পরস্পরকে এমন আকুলে কোলাকুলি করছিলাম বারেবার, যেন ঐ দিনটা এই দুনিয়ায় আর কোনোদিনই আসবে না! আমরা চিৎকার করে ডাকছিলাম─ "অ মা!... মা রে!... অ মা!"... হামিদ তখন সিগ্রেট ধরিয়ে, তাকিয়ে ছিল দূরে... বহু দূরে!... হামিদ কী ভাবছিল?
ভারত থেকে ফিরে আসছিলাম ছয় সাথী, স্বাধীন মাতৃভূমির বুকে, ঘরে। দাড়িতে, স্যান্ডোতে, মালকোচা লুঙ্গিতে, ছয় জন চাষা, ছয় জন শ্রমিক, ছয় জন গাঁইয়া, ছয় জন অসভ্য। আমরা ফিরছিলাম। তখনই, ডাক দিলো হামিদ─ "দাঁড়া!"...
দাঁড়িয়ে পড়লাম, সটান! আশিষ ও রফিক তো চট করে গানই হাতে নিয়ে নিলো কাঁধ থেকে! অভ্যাস।
হামিদের চোখ অনুসরণ করে, ঝোপের আড়ালের পোড়োবাড়িটার দিকে, তাকালাম আমরা। কান পাততেই, স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ফিসফিস কান্না!
নারীকণ্ঠ!
ছুটছে হামিদ! সোজা! ঝোপঝাড় ভেঙে! দুনিয়াকে মাড়িয়ে দু'পায়! কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে জল্লাদ হামিদ! ডান হাতে সামনের দিকে তাক করা তার, এলএমজি। আজ কেয়ামত!
ছয় জন যুবক যখন পৌঁছলাম আস্তর-খসা বাড়িটির পেছনে, স্থির হয়ে গেলো ক্যাপ্টেন! জানালা খোলা। আমরা দেখলাম, ভিতরে গহন আঁধার! না, আলো আছে, সূর্যের থইথই আলো; তবুও, আঁধার! গহন আঁধার! ভিতরে আমার মা, ভিতরে আমার বোন, ভিতরে আমার কন্যা, ভিতরে আমার দেশ! ভিতরে আমার উ'লঙ্গ মাতৃভূমি! সামনে আগালাম আমরা পাঁচ জন। দরোজায় তালা, বাইরে থেকে।
ভাঙলাম। নেই। আমাদের গায়ে এমন কিচ্ছু নেই, আমার বাংলাদেশ আব্রু ঢাকবে! গত ন'মাসে এই প্রথমবার মনে হলো─ 'আমরা এতো নিঃস্ব কেন?'
আশিষ কাঁদছিল, দরদর! রফিক, গৌতম আর রহমান, হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো উপুড়! যেন সিজদা দিচ্ছে পরম প্রার্থনালয়ে! যেন নুয়ে আছে দেবীমা'র সুমুখে! যেন, বলতে চাইছে─ 'মাফ চাই গ মা! ক্যামনে তাকাই তর অপমানোর দিক?'
সাজু আগালো। একে-একে পা ছুঁলো তেরো জন নারীর। কেন? আজও জানি না। আমরা, ছেঁড়া স্যান্ডোগেঞ্জিগুলো খুললাম। জাঙ্গিয়া রেখে, খুলে ফেললাম ময়লা লুঙ্গি। ওগুলো, হাতে তুলে দিয়ে তাঁদের, দাঁড়িয়ে রইলাম, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, যেন নির্বোধ শিশু! দু'জন দেহ ঢাকলেন, বাকি সবাই নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন কাপড়গুলোর দিকে! টপ!... টপ!... টপ!...
আমার মাতৃভূমি কাঁদছে। আমার মা কাঁদছে।
তখনই চোখ পড়লো হামিদের দিকে। জানালার শিক আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে হামিদ। বাইরে। জল্লাদ হামিদ। যে হামিদ শিস দিয়ে-দিয়ে নেড়িকুত্তার মাথা ভেঙে দিতো বুটের তলায়, যে হামিদ জাতীয় সঙ্গীত গাইতে-গাইতে গলা ফেঁড়ে দিতো শুয়োরের, যে হামিদ মায়ের নির্মম মৃত্যুর সংবাদ শুনে চোখ মুছেছিল মাত্র দুইবার, যে হামিদ স্ত্রীর তলপেট চিরে ফেলার খবরে ঝিম মেরে বসে ছিলো শুধুমাত্র দুইটা মিনিট, সেই পাথর হামিদ, আমার বন্ধু হামিদ, আমার ক্যাপ্টেন হামিদ, পা'কিস্তানি মিলিটারির নাম দেওয়া জল্লাদ হামিদ, ভেসে যাচ্ছে অশ্রুজলে!
হামিদ কাঁদছে! ঝরঝর কাঁদছে হামিদ! সন্তান হামিদ, অপলক তাকিয়ে রয়েছে, তার অপমানিত মায়ের দিকে! অপমানিত বাংলাদেশের দিকে!
আমার বাংলাদেশ এভাবে জন্মেছে।
No comments:
Post a Comment