খুবই পরিচিত একটি শব্দ— গুড়। এককালে বাঙালি ঘরে অতিথি এলে গুড়-জল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হতো। বাঙালি ঘরের শিশুরা দুধ-গুড় আর গুড়-মুড়ি খেয়ে বড়ো হতো। এখনকার মতো তখন প্যাকেটজাত শিশুখাদ্য ছিল না। আর এই প্রিয় গুড় থেকেই দেশটার নাম হয়ে গেল গৌড়দেশ, সংক্ষেপে “গৌড়।”
প্রাচীন বাংলার ( অন্য বানানে “বাঙলা” ) নাম ছিল গৌড়। পাঁচটি মৌলিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পুরো দেশটি পরিচিত ছিল পঞ্চগৌড় নামে।
১) পঞ্চগৌড়ের প্রথম ভাগ ছিল লাল মাটির দেশ “রাঢ়।” ভাগীরথীর পশ্চিম তীরের এলাকায় অবস্থিত আজকের বীরভূম, বর্ধমান, মেদিনীপুর, হুগলি, হাওড়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মুর্শিদাবাদ, দুমকা, সাহেবগঞ্জ, দেওঘর, গোড্ডা, ধানবাদ, পুরুলিয়া, সিংভূম, রাঁচির পূর্ব অংশ, গিরিডির দক্ষিণ-পূর্ব অংশ নিয়ে ছিল রাঢ়। সবচেয়ে বড়ো এই এলাকা।
২) গৌড়ের দ্বিতীয় এলাকা ছিল গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের ব-দ্বীপ এলাকা। এর নাম ছিল “সমতট, ” সাধারণভাবে বলা হতো “বাগড়ি।” পূর্ব মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিণ দুই চব্বিশ পরগণা, কলকাতা এবং বর্তমান বাংলাদেশের খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, গোয়ালন্দ, গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী ছিল এই এলাকায়।
এই সমতটের রাজা ভগীরথ পদ্মা থেকে গঙ্গা, জলঙ্গী প্রভৃতি একশোটি খাল কেটে তাকে সমুদ্রের সঙ্গে জুড়েছিলেন। সেজন্য গঙ্গার আরেক নাম হয়ে যায়, শতমুখী। রামায়ণের সগর রাজা ছিলেন এই সমতটের রাজা। তাঁর “সগর” নাম থেকেই হয়েছে “সাগর।”
৩) তৃতীয় অংশ ছিল বরেন্দ্র। গঙ্গার উত্তরে আজকের মালদহ ও দিনাজপুর এলাকা।
৪) গঙ্গার উত্তর তীরে ছিল বিদেহ বা মিথিলা। রাজা মিথি এই দেশ জয় করে ত্রিহোত্রীয় যজ্ঞ করেছিলেন। তাই এর আরেক নাম তিরহুত অর্থাৎ তীরভূমি। পঞ্চগৌড়ের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে ছোট এলাকা।
৫) এর পরের অংশ “বঙ্গ।” গৌড়দেশের নদীমাতৃক এলাকা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের ঢাকা অঞ্চল ছিল এই এলাকার অন্তর্ভুক্ত।
আর বঙ্গের কাছাকাছি এলাকা পরিচিত ছিল “বঙ্গাল” নামে। অনেকে মোগল যুগের লেখক আবুল ফজলের “আইন-ই-আকবরী” থেকে “বঙ্গাল” শব্দের ব্যাখ্যা করেন, “বঙ্গ” + “আল” = বঙ্গাল অর্থাৎ আল দিয়ে ঘেরা যে দেশ, তার নাম “বঙ্গাল” বলে থাকেন।
কিন্তু বৌদ্ধযুগ থেকেই “বঙ্গাল” শব্দটির ব্যবহার রয়েছে। চর্যাপদে দেখা যাচ্ছে, “ভুসুকু আজ তু বঙ্গালী ভইলী।” কাজেই মোগল আমলের বহু আগে থেকেই এই দেশের নাম “বঙ্গাল।” বঙ্গের কাছাকাছি যে অঞ্চল, তার নাম ছিল “বঙ্গাল।” সংস্কৃতে যা ছিল গৌড়দেশ, বাংলায় তা হয়ে যায় “বাঙলাদেশ।” ফিরে আসি গৌড়ের নামকরণ প্রসঙ্গে। এই দেশ ছিল আখের গুড়, তাল গুড়, খেজুর গুড়ে সমৃদ্ধ এলাকা। বৈদিক শব্দ “গুড়।” এই “গুড়” শব্দের সঙ্গে তদ্ধিত “ষ্ণ” প্রত্যয় যোগে উৎপন্ন হয় “গৌড়” শব্দ। এখান থেকে তৈরি গুড় রপ্তানি হতো বিভিন্ন দেশে। এমনকি, যখন পোর্তুগীজরা এদেশে এসেছিলেন, তখন তাঁরা এদেশ থেকে মূলত গুড় ও চিনি রপ্তানি করতেন। এজন্য তাঁরা এদেশের সপ্তগ্রাম ও চট্টগ্রাম বন্দর দুটিকে ব্যবহার করতেন। এভাবেই গুড়ের দেশ হিসেবে ব্যাপক অর্থে পঞ্চ গৌড় মিলে গোটা উত্তর ভারতের নাম হয়ে যায় “গৌড়দেশ।” আর সাধারণভাবে “গৌড়দেশ” বলতে বোঝায় “বাঙলা।” বৌদ্ধযুগের পরে ব্রাহ্মণদের গাঞি-গোত্রাদি নির্ধারণের জন্য প্রয়াগে একটি বড়ো মেলা বসেছিল। অনেক আলোচনার পর শেষে ভারতের দশ শ্রেণির ব্রাহ্মণকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে পাঁচ শ্রেণির ছিল উত্তর ভারতের এবং এঁদের নাম দেওয়া হয়েছিল “পঞ্চগৌড়ী। জম্মু, কাশ্মীর, পাঞ্জাবের সারস্বত ব্রাহ্মণ এবং রাজস্থান, হরিয়াণার গৌড় ব্রাহ্মণ। এই ব্রাহ্মণরা গৌড়দেশ থেকে গিয়েছিলেন বলে এঁদের বলা হয়েছে গৌড় ব্রাহ্মণ। এঁরা মাছ-মাংস খেতেন না। আর বাঙলার ব্রাহ্মণরা মাছ-মাংস খেতেন বলে তাঁরা স্বীকৃতি পাননি।
অন্যদিকে, অন্য পাঁচ শ্রেণির ব্রাহ্মণ ছিলেন পঞ্চ দ্রাবিড়ী ব্রাহ্মণ। এঁদের মধ্যে ছিলেন উত্তর প্রদেশের কনৌজী ব্রাহ্মণ, গুজরাটের নাগর ব্রাহ্মণ এবং উত্তর বিহারের মৈথিলী ব্রাহ্মণ। যাই হোক, গুড় থেকেই যে গৌড় হয়েছে তা বোঝা গেল। গুড় বাংলায় একটি জনপ্রিয় খাদ্য। শীতকালে খেজুর গুড় শীতের নতুন বার্তা বয়ে আনে। তাই শীতকালে খেজুর গুড় থেকে তৈরি পাটালির সংস্কৃত নাম “নববার্তা, ” যা থেকে চলতি কথায় হয়েছে “নবাত।” অন্যদিকে, ফাল্গুনে তৈরি এখো গুড় অর্থাৎ আখের গুড়ের ব্যাপক ব্যবহার হয় বাঙালির দুর্গাপুজোর সময় বিভিন্ন ধরণের নাড়ু, আরশে তৈরিতে।
তাই গুড় বৈদিক যুগ থেকে এখনো সমান জনপ্রিয়। গুড় থেকে গৌড় নামটিও সার্থক।
No comments:
Post a Comment