
ইহুদি, খ্রিস্টান, এবং ইসলাম ধর্ম আব্রাহামিক ঐতিহ্য ও ধর্মতত্ত্বের একটি প্রবাহ। কাঠামোগত দিক থেকে তিনটি ধর্মই এক, একই ঈশ্বর, হুবহু একই সৃষ্টিতত্ত্ব ও বিশ্বদর্শন এবং একই ইহকাল পরকালের ধারণা নিয়ে গঠিত। এই তিনটি ধর্মই আব্রাহামিক ঐতিহ্যের অংশ হলেও তাদের ধর্মতত্ত্বে সামান্য বিরোধ রয়েছে। ইহুদি ধর্ম কঠোর একেশ্বরবাদ, ঈশ্বরের আইন পালন, এবং ইসরাইলি জাতীয় চুক্তির উপর জোর দেয়, যা খ্রিস্টান ত্রিত্ববাদ, যিশুর পরিত্রাণ এবং ইসলামের তাওহিদ ও মুহাম্মদের নবুওতের সাথে বিরোধী। খ্রিস্টান ত্রিত্ববাদ হল ঈশ্বর একজন, কিন্তু তিনি তিনটি ভিন্ন সত্তা হিসেবে প্রকাশিত – যা পিতা হিসাবে ঈশ্বর, পুত্র হিসাবে যিশু, ও পবিত্র আত্মা হিসাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাস করে। খ্রিস্টান ধর্মের ত্রিত্ববাদ এবং মূল পাপের ধারণা (অরিজিনাল সিন) উভয় ধর্মের সাথে সবচেয়ে বড় বিরোধ সৃষ্টি করে। ইসলাম ইহুদি ধর্মের সাথে একেশ্বরবাদ ও স্বাধীন ইচ্ছার ক্ষেত্রে মিলে কিন্তু ধর্মগ্রন্থ ও নবুওত নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে। যেমন তিনটি ধর্মের কোন ধর্মই তার পরের নবী বা ধর্মগ্রন্থকে মানে না। তিনটি ধর্মই নৈতিক জীবন ও ন্যায়বিচারের উপর জোর দেয়। তাদের মধ্যে এই বিরোধগুলো ধর্মের দার্শনিক কাঠামোগত নয়, বরং মূলনীতি লঙ্ঘন সংক্রান্ত বা প্রফেনিক ।
ইহুদি ধর্মের গঠন প্রায় ২০০০–১২০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে ঘটে, যখন আব্রাহামিক ঐতিহ্য থেকে শুরু করে নবী মুসার নেতৃত্বে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়ে ইসরাইল-সিরিয়া অঞ্চলে কানানীয়, মেসোপটেমিয়, এবং মিশরীয় ধর্মের প্রভাব ছিল। কানানীয় দেবতা এল, বাল, এবং আশেরা ইহুদি ধর্মের প্রাথমিক রূপে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে, যদিও ইহুদিরা এই ধারণাগুলোকে পুনর্নির্মাণ করে ইয়াহওয়ে-কেন্দ্রিক একেশ্বরবাদ গড়ে তোলে। মেসোপটেমিয় ধর্ম সৃষ্টি কাহিনী (জেনেসিস) ও চুক্তির ধারণায়, এবং মিশরীয় ধর্ম সম্ভাব্য একেশ্বরবাদী চিন্তায় প্রভাব ফেলে। তবে, ইহুদি ধর্মের নৈতিক ও একেশ্বরবাদী প্রকৃতি এটিকে স্থানীয় ধর্মগুলো থেকে স্বতন্ত্র করে।
ইহুদি ধর্মের গঠনের সূচনা প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১২০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত ধরা হয়, যদিও এর আনুষ্ঠানিক রূপ পরবর্তী সময়ে (প্রায় ১০০০ খ্রিস্টপূর্ব) আরও স্পষ্ট হয়। এই সময়কালে ইহুদি ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য—একেশ্বরবাদ, ইয়াহওয়ে (Yahweh) এর উপাসনা, এবং ধর্মীয় আইনের ধর্মগ্রন্থ (তোরাহ)—ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।
ইহুদি ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টের জন্ম পর্যন্ত একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা মধ্যপ্রাচ্যের কেনান (বর্তমান ইসরায়েল/ফিলিস্তিন), মিশর, মেসোপটেমিয়া এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ঘটে। এই সময়ে ইহুদি ধর্ম একেশ্বরবাদ, টোরাহর আইন, এবং ইসরায়েলীয় জাতিগত পরিচয়ের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে গড়ে ওঠে। নীচে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে এই ইতিহাস বর্ণনা করা হল, হিব্রু বাইবেলের (তানাখ) ধর্মীয় ও মিথিক্যাল বর্ণনার সঙ্গে যোগসূত্র রেখে।
খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে কেনানে ইসরায়েলীয়দের উপস্থিতি প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে নিশ্চিত হয়। এই সময়টি দেরী ব্রোঞ্জ যুগের শেষ এবং প্রাথমিক লৌহ যুগের শুরু, যখন কেনান অঞ্চল মিশরীয় প্রভাব, ফিলিস্তিনী আগ্রাসন, এবং স্থানীয় কেনানীয় শহর-রাষ্ট্রের মধ্যে অস্থিতিশীল ছিল। মিশরীয় ফারাও মেরনেপ্তাহর একটি শিলালিপিতে “ইসরায়েল” নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা ইসরায়েলীয়দের প্রাচীনতম লিখিত প্রমাণ। এটি নির্দেশ করে যে ইসরায়েল একটি জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায় হিসেবে কেনানে বিদ্যমান ছিল, সম্ভবত পাহাড়ি অঞ্চলে।
খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-১০০০ অব্দে কেনানের কেন্দ্রীয় পাহাড়ি অঞ্চলে (যেমন, জুডিয়া, সামারিয়া) ছোট ছোট গ্রামের উত্থান দেখা যায়। এই বসতিগুলো সাধারণ কৃষিভিত্তিক ছিল, মাটির পাত্রে সরল নকশা এবং সেগুলোতে শুকরের হাড়ের অনুপস্থিতি ছিল যা ইহুদি খাদ্যবিধি যেমন শুকর হারামের ইঙ্গিত। এই গ্রামগুলো সম্ভবত ইসরায়েলীয়দের প্রাথমিক বসতি ছিল।
ইসরায়েলীয়দের উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে তিনটি প্রধান তত্ত্ব রয়েছে। প্রথমটি হল বিজয় মডেল। এই মডেলে হিব্রু বাইবেলের যিহোশূয়া বই অনুসারে, ইসরায়েলীয়রা বাইরে থেকে এসে কেনান বিজয় করে। তবে, সেইরকম বড় আকারের বিজয়ের কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়টি হল শান্তিপূর্ণ অনুপ্রবেশ মডেল এই মডেল অনুসারে ইসরায়েলীয়রা ধীরে ধীরে কেনানে প্রবেশ করে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যায়। তৃতীয়টি হল অভ্যন্তরীণ উত্থান মডেল। এই মডেলে ইসরায়েলীয়রা স্থানীয় কেনানীয়দের মধ্যে থেকেই উদ্ভূত হয়, সম্ভবত সামাজিক ও ধর্মীয় বিপ্লব বা পরিবর্তনের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, এই সময়ে কেনানে বহুদেববাদ প্রচলিত ছিল (যেমন, বাল, আশেরা উপাসনা)। তবে, কিছু স্থানে এক ঈশ্বরে ইয়াহওয়ের উপাসনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা ইসরায়েলীয়দের সঙ্গে যুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, কিছু শিলালিপিতে “ইয়াহওয়ে” নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
হিব্রু বাইবেলের যিহোশূয়া এবং বিচারক বই অনুসারে মুসার উত্তরসূরি যিহোশূয়া ইসরায়েলীয়দের কেনানে নিয়ে যান এবং শহরগুলো (যেমন, যিহোরিখো, আই) বিজয় করেন। ঈশ্বরের নির্দেশে তারা কেনানীয়দের পরাজিত করে এবং বারো গোত্রের মধ্যে ভূমি বণ্টন করে। যিহোশূয়ার পর ইসরায়েলীয়রা বিচারকদের দ্বারা শাসিত হয়, যারা ধর্মীয় ও সামরিক নেতা হিসেবে কাজ করত। এই সময়ে ইসরায়েলীয়রা বহুদেববাদের প্রভাবে পড়লেও ঈশ্বর ইয়াহওয়ের প্রতি আনুগত্যের জন্য নবী ও বিচারকদের দ্বারা সংশোধিত হত। হিব্রু বাইবেলে বলা হয়, ইসরায়েলীয়রা এক ঈশ্বরের উপাসনা করত, তবে স্থানীয় দেবতা (যেমন, বাল) এর প্রভাব ছিল। এই সময়ে একেশ্বরবাদ সম্ভবত হেনোথিইজম (এক ঈশ্বরের প্রাধান্য) আকারে ছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, বড় আকারের বিজয়ের প্রমাণ না থাকলেও পাহাড়ি অঞ্চলের গ্রামগুলো ইসরায়েলীয়দের উত্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হিব্রু বাইবেলের বর্ণনা সম্ভবত এই গ্রামবাসীদের ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় গঠনের প্রক্রিয়াকে প্রতীকীভাবে বর্ণনা করে।
খ্রিস্টপূর্ব ১০ম শতাব্দীতে ইসরায়েলীয় সমাজ একটি কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। এই সময়টি লৌহ যুগের শুরু, যখন কেনানে শহর-রাষ্ট্রগুলো শক্তিশালী হয় এবং ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাড়ে। জেরুজালেমে খ্রিস্টপূর্ব ১০ম শতাব্দীর স্থাপত্য (যেমন, স্টেপড স্টোন স্ট্রাকচার) একটি কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের ইঙ্গিত দেয়। তবে, জেরুজালেম তখনও ছোট ছিল। হাজোর, মেগিদ্দো, এবং গেজের শহরে দৃঢ় প্রাচীর ও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, যা একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। কিছু পণ্ডিত এগুলোকে রাজা সলোমনের সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করেন, যদিও এটি বিতর্কিত। তেল দান স্টেলে “দাউদের বংশ” (House of David) এর উল্লেখ রয়েছে, যা দাউদের ঐতিহাসিক অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত।
প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, এই সময়ে বহুদেববাদী মূর্তি ও উপাসনাস্থল ছিল। তবে, কিছু শিলালিপি ও ধর্মীয় নিদর্শনে ইয়াহওয়ে -এর উপাসনার প্রাধান্য দেখা যায়, যা ইহুদি ধর্মের একেশ্বরবাদী পরিচয়কে শক্তিশালী করে। ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং আঞ্চলিক শক্তি (যেমন, মোয়াব, এদোম) এর উত্থান ইসরায়েলীয়দের কেন্দ্রীভূত শাসনের দিকে ঠেলে দেয়।
হিব্রু বাইবেলের স্যামুয়েল, কিংস, এবং ক্রনিকলস বই অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ১০২০ এর দিকে শাউল ইসরায়েলের প্রথম রাজা হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, তবে তার শাসন অস্থিতিশীল ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-৯৬০ এর সময় দাউদ জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইসরায়েলকে একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেন এবং একেশ্বরবাদী উপাসনাকে কেন্দ্রীভূত করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৯৬০-৯৩০ এর দিকে সলোমন জেরুজালেমে প্রথম মন্দির নির্মাণ করেন, যা ইয়াহওয়ের উপাসনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তিনি ইসরায়েলের সীমানা সম্প্রসারণ করেন এবং তোরাহর আইনকে শক্তিশালী করেন। তবে, তার শাসনের শেষে বহুদেববাদের প্রভাব ফিরে আসে। দাউদ ও সলোমনের সময়ে মন্দিরকেন্দ্রিক উপাসনা এবং পুরোহিতদের (লেভাইট) ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয়। তোরাহর মৌখিক ঐতিহ্য এই সময়ে আরও সুসংগঠিত হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে তেল দান স্টেলে দাউদের বংশের উল্লেখ এবং হাজোর-মেগিদ্দোর দুর্গ প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে হিব্রু বাইবেলের বর্ণনাকে সমর্থন করে। তবে, দাউদ ও সলোমনের রাজ্যের বিশালতা সম্ভবত বাইবেলে অতিরঞ্জিত। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, এটি একটি আঞ্চলিক শক্তি ছিল, বিশাল সাম্রাজ্য নয়।
রাজা সলোমনের মৃত্যুর পর ইসরায়েল রাজ্য দুভাগে বিভক্ত হয়: উত্তরে ইসরায়েল এবং দক্ষিণে জুডিয়া। এই সময়ে ইহুদি ধর্ম আরও সুনির্দিষ্ট রূপ নেয়। উত্তর ইসরায়েলের রাজধানী হয় সামারিয়া। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, সামারিয়ায় প্রাসাদ ও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এই রাজ্যে বহুদেববাদ (বাল উপাসনা) প্রচলিত ছিল, তবে ইয়াহওয়ের উপাসনাও ছিল। দক্ষিণে জুডিয়ার রাজধানী হয় জেরুজালেম। জেরুজালেম মন্দির একেশ্বরবাদের কেন্দ্র ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, জুডিয়ায় ধর্মীয় শিলালিপি এবং ইয়াহওয়ের উপাসনার প্রমাণ পাওয়া যায়।
ওই সময় বাহিরের শত্রু মেসোপটেমিয়ান শক্তি (আসিরিয়া, ব্যাবিলন) এবং মিশরের সঙ্গে সংঘর্ষ বাড়ে। মেসাইক স্টেলে মোয়াবের রাজা মেসার বিজয় এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষের উল্লেখ রয়েছে, যা হিব্রু বাইবেলের বর্ণনার সঙ্গে মিলে। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ সালে আসিরিয়রা উত্তরের ইসরায়েল রাজ্য ধ্বংস করে এবং অনেক ইসরায়েলীকে নির্বাসনে পাঠায় (দশ গোত্রের হারিয়ে যাওয়া)। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, সামারিয়ার ধ্বংস এই ঘটনার প্রমাণ দেয়।
জুডিয়ার রাজা হিজকিয়া (খ্রিস্টপূর্ব ৭১৫-৬৮৭) এবং যোশিয়া (খ্রিস্টপূর্ব ৬৪০-৬০৯) বহুদেববাদী উপাসনাস্থল ধ্বংস করে এবং জেরুজালেম মন্দিরে উপাসনা কেন্দ্রীভূত করেন। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, হিজকিয়ার শাসনকালে জেরুজালেমের প্রাচীর ও জল সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি দেখা যায়। যোশিয়ার সময়ে “আইনের বই” (সম্ভবত ডিউটেরোনমি) পাওয়া যায়, যা তোরাহর কেন্দ্রীভূতকরণের ইঙ্গিত দেয়।
হিব্রু বাইবেল অনুসারে সলোমনের পুত্র রেহোবোয়ামের শাসনকালে রাজ্য বিভক্ত হয়। উত্তর ইসরায়েলে বহুদেববাদ প্রচলিত হয়, যখন জুডিয়া জেরুজালেম মন্দিরের উপর কেন্দ্রীভূত থাকে। এই সময় এলিয়া, এলিশা, ইশাইয়া, এবং যিরমিয়ার মতো নবীরা একেশ্বরবাদ এবং তোরাহর আইন মেনে চলার জন্য সতর্ক করেন। তারা বহুদেববাদ ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন। হিজকিয়া ও যোশিয়ার সংস্কার জেরুজালেম মন্দিরকে ইহুদি ধর্মের একমাত্র কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং তোরাহর আইনকে রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করে।
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ (যেমন, মেসাইক স্টেলে, সামারিয়ার ধ্বংস) এবং হিব্রু বাইবেলের বর্ণনা উত্তর ও দক্ষিণ রাজ্যের বিভক্তি ও আসিরিয়ার বিজয়ের বিষয়ে মিলে যায়। হিজকিয়া ও যোশিয়ার সংস্কার প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জেরুজালেমের উন্নতি ও ধর্মীয় শিলালিপির মাধ্যমে সমর্থিত।
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ব্যাবিলনীয়রা জুডিয়া রাজ্য ধ্বংস করে, যা ইহুদি ধর্মের বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৭ এর দিকে ব্যাবিলনের রাজা নেবুখাদনেজার জেরুজালেমের মন্দির ধ্বংস করেন এবং জুডিয়ার অভিজাতদের ব্যাবিলনে নির্বাসনে পাঠান। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, জেরুজালেমে ধ্বংসের চিহ্ন এবং ব্যাবিলনে ইহুদি নামের শিলালিপি (যেমন, আল-ইয়াহুদু ট্যাবলেট) এই নির্বাসনের প্রমাণ দেয়। ব্যাবিলনে ইহুদিরা সিনাগগ উপাসনার প্রথা শুরু করে এবং তোরাহর লিখিত রূপ গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, এই সময়ে হিব্রু লিপির বিকাশ দেখা যায়।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ এর দিকে পারস্যের রাজা সাইরাস ব্যাবিলন জয় করেন এবং ইহুদিদের নিজ ভূমি জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, সাইরাস সিলিন্ডারে লেখা তার ধর্মীয় সহনশীলতার নীতির বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে যেটি ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের প্রথম দলিল।
হিব্রু বাইবেলের কিংস ও যিরমিয়া বই ব্যাবিলনীয় বিজয় ও নির্বাসনের বর্ণনা দেয়। নবী যিরমিয়া ইহুদিদের ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এবং তোরাহ মেনে চলার জন্য সতর্ক করেন। নবী ইজেকিয়েল ও ইশাইয়া নির্বাসনে ইহুদিদের আশা জাগান এবং একেশ্বরবাদকে আরও শক্তিশালী করেন। তোরাহ গ্রন্থ আকারে এই সময়ে সম্পাদিত হয়। এজরা ও নেহেমিয়া বই অনুসারে, ইহুদিরা জেরুজালেমে ফিরে এসে দ্বিতীয় মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। তখন তোরাহকে রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ব্যাবিলনীয় নির্বাসন ও পারসিক প্রত্যাবর্তনের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হিব্রু বাইবেলের বর্ণনার সঙ্গে মিলে। নির্বাসন ইহুদি ধর্মকে মন্দিরকেন্দ্রিক থেকে তোরাহকেন্দ্রিক ধর্মে রূপান্তরিত করে। দ্বিতীয় মন্দির যুগে ইহুদি ধর্ম একটি সুনির্দিষ্ট ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ এর সময় জেরুজালেমে দ্বিতীয় মন্দির নির্মিত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ সীমিত, তবে পারসিক শাসনকালে জেরুজালেমের পুনর্গঠনের প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম-৪র্থ শতাব্দীতে তোরাহর লিখিত রূপ চূড়ান্ত হয়। এজরা, একজন পুরোহিত ও শাস্ত্রবিদ, তোরাহকে জুডিয়ার আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, হিব্রু ও আরামাইক শিলালিপি এই সময়ে তোরাহর প্রভাব নির্দেশ করে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২-১৬৭ এর সময় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়ের পর জুডিয়া গ্রিক শাসনের অধীনে আসে। হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি ইহুদি ধর্মের উপর চাপ সৃষ্টি করে। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, জুডিয়ায় গ্রিক মুদ্রা ও স্থাপত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১৬৭-১৬০ এর দিকে গ্রিক শাসক অ্যান্টিওকাস চতুর্থের ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে ম্যাকাবী বিদ্রোহ সফল হয়, যার ফলে হয় হানুক্কা উৎসবের উৎপত্তি। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, এই সময়ে জুডিয়ার সামরিক দুর্গের প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে খ্রিস্টের জন্ম হয়। সেই সময় রোমানরা জুডিয়া দখল করে। হেরোদ দ্য গ্রেট (খ্রিস্টপূর্ব ৩৭-৪) দ্বিতীয় মন্দিরকে পুনর্নির্মাণ করেন। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, হেরোদের মন্দিরের দেয়াল (ওয়েস্টার্ন ওয়াল) এবং জেরুজালেমের স্থাপত্য এর প্রমাণ দেয়।
খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে ফরিসী, সদ্দুকী, এসিন, এবং জেলটদের মতো ইহুদি গোষ্ঠী উদ্ভূত হয়। ফরিসীরা তোরাহর মৌখিক ঐতিহ্য এবং পুনরুত্থানে বিশ্বাস করত, যখন সদ্দুকীরা শুধু লিখিত তোরাহ গ্রহণ করত। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, কুমরানের ডেড সি স্ক্রল (খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী) এসিনদের ধর্মীয় লেখার প্রমাণ দেয়। এজরা ও নেহেমিয়া তোরাহকে কেন্দ্রীভূত করে এবং শাব্বাত, খৎনা, এবং কোশার আইনকে শক্তিশালী করে। হাগাই ও জাকারিয়ার মতো নবীরা মন্দির পুনর্নির্মাণে উৎসাহ দেন।
ম্যাকাবী পুস্তক (অ্যাপোক্রিফা) অনুসারে, ম্যাকাবীরা গ্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং মন্দির পুনঃপবিত্র করে। এটি ইহুদি ধর্মের স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠে। নবীদের লেখা (যেমন, ইশাইয়া, ড্যানিয়েল) এবং অ্যাপোক্রিফাল গ্রন্থে মশীহের (অভিষিক্ত মুক্তিদাতা) ধারণা বিকশিত হয়। এটি খ্রিস্টের জন্মের সময় ইহুদি সমাজে ব্যাপক প্রত্যাশা সৃষ্টি করে।
প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে, দ্বিতীয় মন্দির, ডেড সি স্ক্রল, এবং হেরোদের স্থাপত্য হিব্রু বাইবেল ও অ্যাপোক্রিফার বর্ণনাকে সমর্থন করে। মশীহের ধারণা ইহুদি ধর্মের মধ্যে বিকশিত হয় এবং খ্রিস্টধর্মের উদ্ভবের পটভূমি তৈরি করে।
ইহুদি ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য (খ্রিস্টের জন্ম পর্যন্ত):
১। একেশ্বরবাদ: ইয়াহওয়ে একমাত্র ঈশ্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ব্যাবিলনীয় নির্বাসনের পর একেশ্বরবাদ কঠোর হয়।
২। তোরাহ বা ইহুদি বাইবেল: জেনেসিস, এক্সোডাস, লেভিটিকাস, নাম্বার্স, ডিউটেরোনমি ইহুদি ধর্মের পবিত্র পাঁচটি গ্রন্থ, নবীগণ ও লেখা (Prophets, Writings) এই সময়ে সংকলিত হয়।
৩। মন্দির ও সিনাগগ: দ্বিতীয় মন্দির উপাসনার কেন্দ্র, যখন সিনাগগ তোরাহ পাঠ ও শিক্ষার স্থান হয়ে ওঠে।
৪। উৎসব ও আইন: শাব্বাত, পাসওভার, হানুক্কা, এবং কোশার খাদ্যবিধি (হারাম হালালা) ইহুদি পরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে।
এই বৈশিষ্ট্যগুলোর ভিত্তিতেই পরবর্তিতে খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়ের পর জুডিয়া গ্রিক শাসনের অধীনে আসে। হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি ইহুদি ধর্মের উপর চাপ সৃষ্টি করে। সেই সময়ের পর থেকে গ্রিক নিপীড়নের সময় শুরু হয়। তার পর রোমানরা জুডিয়া দখল করে। এই সময়ে জুডিয়ার সামরিক দুর্গের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সময় খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে ফরিসী সম্প্রাদয় গঠিত হয় যারা ধর্মীয় কপটতা, ধর্মীয় আইনের আক্ষরিক ব্যাখ্যা, বাহ্যিক প্রদর্শন, এবং নৈতিক গভীরতার অভাব প্রদর্শন করতে থাকে। ঠিক যেমন কিছু ইসলামী প্রচারক যারা হাদিসের উপর অতিরিক্ত নির্ভর করে (বিশেষত সন্দেহজনক বা দুর্বল হাদিস) এবং কুরআনের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে আক্ষরিক বা কঠোর ব্যাখ্যার উপর জোর দেয়, তাদের সাথে ফরীশীদের মিল লক্ষণীয়। একদিকে গ্রীক ও রোমানদের অত্যাচার এবং অপরদিকে ফরীশীদের ধর্মের আক্ষরিক ও বাহ্যিক প্রয়োগ মানুষকে অতিষ্ট করে ফেলে। যার ফলে একটি শান্তি ও সহনশীলতার ব্যক্তিগত শুদ্ধিকরণের ধর্মের জন্য মানুষের মন মুখিয়ে থাকে।