চল্লিশ বিয়াল্লিশ ডিগ্রি গরম আমাদের ছোটবেলায় পড়ত কিনা আজ আর মনে পড়েনা। পুরোনো বাড়ির মোটা ইঁটের গাঁথনি, লাল ঢালাই মেঝে, জানলায় সুতির পর্দা - নরম অথচ ঘর অন্ধকার করা, বাড়ির আশেপাশে গোটা দুয়েক পুকুর আর বিরাট বিরাট প্রাচীন গাছের ছায়া ; এই সব মিলিয়ে গরম কালটা তেমন টের পেতাম না। বেলায় স্নান সেরে চন্দন মাখলে যেকোনো বাজারচলতি পাউডারের থেকেও ঠাণ্ডা হত গা। পুরোনো দিনের পাখা ঘটঘট আওয়াজ তুলে ঘুরত, ঠাণ্ডা মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে তপ্ত দুপুরের তাত গায়ে লাগতনা। সন্ধ্যে বেলা পড়তে বসলেই কারেন্ট অফ, পুকুরের দিকের জানলা দিয়ে দিব্যি ঠাণ্ডা হাওয়া আসত, আর আসত গন্ধরাজের সুগন্ধ। রাত আরেকটু গড়ালে দোতলার ছাতে গিয়ে দাঁড়ালে চোখে পড়ত নারকোল গাছের পাতায় বাতাস লেগে দুলুনির সাথে লক্ষ তারার লুকোচুরি। চাঁদের আলো পুকুরের জলে পড়ে পিছলে যেত, দূরে রেললাইন ধরে আলোর রেখা দেখলে বুঝতে পারতাম রাতের ট্রেনে ঘরে ফিরছে সবাই।
সেই সময় মিছরি মৌরির শরবত ছিল নিত্যদিনের জিনিস। বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে, কিংবা গরমের ছুটিতে দুপুর বেলা এক চটকা ঘুমিয়ে উঠে ঘটিতে ভেজানো মিছরি মৌরির শরবত যে কী ভালো লাগত। ভাতের পাতে আমঝোল হত রোজ, শেষপাতে খাওয়ার জন্য। বাড়ির গাছের কাঁচা আম, সকাল বেলা কুড়িয়ে এনে সেই দিয়ে। নিমপাতা ভেজে তাই দিয়ে আলুভাতে আর এই আমঝোল নাকি লু লাগা প্রতিরোধ করে। তেঁতুল দিয়ে ছোট মাছের টক, পাথরের বাটিতে মজত রান্নাঘরের মিটসেফে। তেঁতুলের টকও গরম কালে খাওয়া ভালো, তাই। রবিবার করে সবাই যখন বাড়িতে থাকত, বেলপানা করত আমার ঠাকুমা। ঠাকুমার হাতেই শেষ বেলপানা খেয়েছি, প্রায় তের-চোদ্দ বছর আগে। সে স্বাদ ভোলার নয়। বিকেলের দিকে উঠোনে তিনটে ইঁট জড়ো করে সেখানে আম পুড়িয়ে ভাজা মশলা-বিটনুন দিয়ে আমপোড়ার শরবত করত বাবা। সন্ধ্যে হলেই কালবৈশাখীর মেঘ আসত মাঠের ওপারের আকাশ জুড়ে। তিনমাথার মোড়ের ক্লাবঘরের সামনে রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যার জলসার জন্য পাতা ত্রিপলগুলো উড়িয়ে, তালগাছের মাথায় উল্টোনো বাবুইপাখির বাসাগুলোতে দুলিয়ে একবুক ঠাণ্ডা বাতাস নিয়ে হইহই করে এসে পড়ত ঝড়, সাথে বৃষ্টি। জলসা সাঙ্গ হত, জুঁইফুলের মালা আর লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা কিশোরীর অনুষ্ঠান বন্ধ হওয়ার দু:খে মুখ ভার - মুদির দোকানের শেডের নিচে ভীড় জমত ছাতা ভুলে আসা মানুষগুলোর। তেলেভাজার দোকানি ঝাঁপ ফেলে পা বাড়াত বাড়ির দিকে। আমরা ঘরে বসে শুনতাম ঝড়ের আওয়াজ। লোডশেডিংয়ে হ্যারিকেনের আলোয় নিজের ছায়া দেখতাম, মা বলত ছায়া দেখলে শরীর খারাপ হয়। ঝড় থামলে বাগান থেকে বালতি ভরে কাঁচা আম, বেল কুড়িয়ে আনত বাবা-দাদারা।
মা পান্তা খেতে খুব ভালোবাসত। প্রায়ই ভাতে জল ঢেলে রাখত গরমের দিনে। আলু ভাতে, ডালের বড়া, কাঁচা পোস্ত বাটা বা আলুর চপ, মাছের টক দিয়ে সেই পান্তা খেতাম আমরা। তখন হয়ত অত ভালো বাসতাম না। কিন্তু এখন ভীষণ ভালো লাগে। অথচ এখন খাওয়ার তেমন সুযোগই হয়না। এই যে পান্তা, গতবছর এপ্রিলে উত্তরপাড়ায় বানিয়েছিলাম। আমি আর বোন খেয়েছিলাম। ডাল ভাতে, আলু চোখা আর কাচকি মাছের টক দিয়ে। লেবুর বদলে কাঁচা আম বাটা দিয়েছিলাম পান্তায়।
No comments:
Post a Comment