মেহরুন আধা ভেজানো দরজাটা একটু সরিয়ে ভিতরে পা রেখেছে।
ড্রয়িংরুমের ডিভান খাটে শুয়ে আছে তার বাবা। বাবা ও তার বড় ভাই নিচুস্বরে কিছু আলোচনা করছে। মেহরুনকে ঢুকতে দেখে তারা দুজনেই কথা বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক তখনই তার ভাইয়ের মেয়ে রাবেয়া বাড়ির ভিতর থেকে ছুটে এসে চেঁচিয়ে উঠল, ‘মেহরুন ফুপু এসেছে-মেহরুন ফুপু এসেছে।’ রাবেয়ার বাবা মেহেরুনের মেঝ ভাই আমান, তার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার গালে লেগে আছে শেভিং সাবানের ফেনা, বুরুশ হাতে ধরা। আমান ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে এমনভাবে মেহরুনের তাকিয়ে রইল যেন সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার বড় বোন আথিজ, যে সুর করে ছোট বাচ্চাদের কুরআন পড়াচ্ছিল, সে ড্রয়িংরুমে ছুটে এলো, মেহরুনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে খেয়াল করেনি তার আঁচল মাথা থেকে খসে পড়েছে। মেহরুনের মায়ের চিকন হাতে তাসবিহ ধরা। তিনি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, যেন তিনি জিজ্ঞেস করছেন: এটা কি সত্যি? এটা আসলেই কি সত্যি? মেহরুনের ছোট দুই বোন, রেহানা ও সাবিহা ড্রয়িংরুমের দরজার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে, রান্নাঘরে রুটিগুলো তাওয়ায় পুড়ে যাচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তার ছোট ভাই আতিফ এখন বাড়ি নেই, এটুকু অন্তত স্বস্তির।
মুহূর্তের জন্য পুরো বাড়িটা থমকে গেছে। মেহরুনের কাছে সব অপরিচিত মনে হচ্ছে। যে মা তাকে নয় মাস গর্ভে ধারণ করেছে, বড় করেছে, তিনি বললেন না, ‘ও তুমি এসেছ, ভেতরে এসো, এসো আমার প্রিয়।’ আর তার বাবা, যে ছোট্ট মেয়েটি তার প্রশস্ত বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লে আনন্দিত হতেন, সেই মেয়েকে এতদিন পরে দেখেও তার মুখে ছোট্ট একটা স্বাগত হাসি পর্যন্ত দেখা গেল না; না হাসি দেখা গেল তার বড় ভাইয়ের মুখে যে তাকে আদর করে ‘আমার পরী’, আমার ফেরেস্তা বলে ডাকত। এমনকি ভাই আমান, যে তাকে কলেজে পাঠানোর সপক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়েছিল, সেও তাকে আজ বাড়িতে স্বাগত জানাল না। ভাইয়ের স্ত্রীরা তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন সে অন্য গ্রহের কেউ।
মেহরুনের হৃদয় ভেঙে গেল। তার কোলে থাকা নয়-মাস-বয়সী বাচ্চাটা যখন তীব্রভাবে চিৎকার করে উঠেছে, তখনই ঘরের সবাই তাদের স্তব্ধতা থেকে বেরিয়ে এলো। বড় ভাই তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এনায়েত কোথায়?’
সে মাথা নিচু করে ফেলল, যেন সে ভীষণ কোনো অন্যায় করে ফেলেছে এমনভাবে বলল, ‘শহরে নেই।’
‘তাহলে তুমি কার সাথে এসেছ?’
‘একা এসেছি।’
‘একা?’ বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তার চারপাশে একটা শোরগোল উঠল।
‘ফারুক, ওকে ভেতরে নিয়ে যাও।’ বড় ভাইয়ের নির্দেশ জারি হতেই মেহরুন ঘরের ভিতরে ঢুকল। তার পা ভারী ও অস্থির। একটা আদালতের বিচার কক্ষের মতো মনে হচ্ছে। বাচ্চাটা চিৎকার শুরু করেছে। বোরখা না খুলে সে মুখ ঢেকে রাখা নিকাবটি উপরে তুলে দিল আর তার বাবা শুয়ে থাকা বিছানার এক কোণে একটু ঘুরে বসল। বাচ্চার মুখে একটা স্তন গুঁজে দিয়েছে। এখনো সে মুখ ধোয়ার সময় পায়নি। বাচ্চাটা দুধ টানতেই তার পেট জ্বলতে শুরু করেছে। গত রাত থেকে সে কিচ্ছু মুখে দেয়নি। এই ঘরে এখন যে আলোচনা হবে সেখানে তার মা ছাড়া আর কোনো নারী উপস্থিত থাকতে পারবে না।
‘মেহের, তুমি যে এখানে আসবে এটা ওই বাড়িতে কাউকে বলে এসেছ?’
‘না।’
‘বাড়ি থেকে বের হবার আগে তাদের জানিয়ে আসোনি কেন? মনে হচ্ছে তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছ আমাদের মুখে চুলকালি মাখিয়েই ছাড়বে।’
‘জানিয়ে আসতে হবে কেন? কে আছে ওখানে? গত এক সপ্তাহ ধরে সে বাড়িতে আসেনি-আমাকে বলেওনি কোথায় যাচ্ছে। আপনাদের সবাইকে আমি চিঠি লিখেছিলাম, কিন্তু আপনারা কেউ কোনো উত্তর দেননি। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি, আপনাদের তাতে কিছু যায় আসে না।’
‘তুমি লিখেছিলে তোমার স্বামী কোনো একটা নার্সের সাথে পালিয়ে গেছে, আর তুমি চাও আমরা এটা বিশ্বাস করি?’
‘আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনাদের উচিত ছিল একবার ওখানে যাওয়া আর ব্যাপারটা যাচাই করে দেখা। অনেকেই তাদের একসাথে দেখেছে।’
‘আর তার সাথে দেখা করে আমাদের কী করা উচিত ছিল? আচ্ছা মনে করো, আমরা তাকে ধরে এই ব্যাপারে ব্যাপক জেরা করলাম, আর সে বলল, হ্যাঁ, কথা সত্যি-আমরা তখন কী করতাম? আমাদের কি মসজিদে বিচার বসাতে হবে? ওখানে গিয়ে সে বলবে, আমি ভুল করেছি, নার্স মেয়েটাকে আমি মুসলমান বানাবো আর তাকে নিকাহ করব। তখন ওই মেয়েটা তোমার সতীন হবে। আর মনে করো, তোমার স্বামীকে আমরা আরো ধমক দিলাম, তখন যদি সে বলে, আমি মেহরুন নামের ওই মহিলাকে চাই না, আমি তাকে তালাক দেব, তখন আমরা কী বলবো।’
এইবার মেহরুন নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। সে অঝোরে কাঁদছে। বাচ্চাটাকে অন্য স্তনে সরিয়ে নিয়ে খাওয়াতে থাকল। বোরখার নিচ থেকে শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে চোখ ও নাক মুছে নিল। ঘরের মধ্যে এক মুহূর্তের নীরবতা নেমে এসেছে।
‘তার মানে আপনারা কিছুই করতে পারবেন না, তাই না?’ কোনো কথা শোনা গেল না। সে বলতে লাগল, ‘আমি আপনাদের পায়ে ধরে বলেছিলাম আমি বিয়ে করতে চাই না। আপনারা আমার কথা শুনেছিলেন? আমি বলেছিলাম, আমি বোরখা পরবো, তবু আমি কলেজে যেতে চাই। আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করেছিলাম আমার লেখাপড়া বন্ধ করে না দিতে । আপনারা কেউ আমার কথা শোনেননি। আমার সাথে একই ক্লাসে পড়া অনেক মেয়ের এখনো বিয়েই হয়নি, আর আমি একটা বুড়ি হয়ে গেছি। আমার উপর এখন পাঁচটা বাচ্চার বোঝা। তাদের বাবা ইচ্ছা মতো যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমার কোনো জীবন নাই। একটা পুরুষমানুষ যখন এমন একটা হারাম কাজ করছে, তখন আপনারা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করতে পারছেন না কেন সে এমন কাজ করছে?’
‘যথেষ্ট হয়েছে মেহের, যথেষ্ট হয়েছে,’ তার মা চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ে।
‘হ্যাঁ, আম্মা, আমারও যথেষ্ট হয়েছে। লোকজন প্রথমে তাকিয়ে থাকত ফিসফাস করত, তারপর যারা তাদের দুজনকে একসাথে থিয়েটারে দেখেছে, হোটেলে ঢুকতে দেখেছে, তারা এসে সরাসরি আমাকে তাদের কথা বলেছে। এরপর তার সাহস বেড়ে গেল। সে ওই মহিলার বাড়িতে যাওয়া আরম্ভ করে দিল। এলাকার সবাই তাকে বকাবকি করার পর সে বেঙ্গালুরু চলে গেছে, হাজার হাজার রুপি খরচ করে মেয়েটাকে এখানে বদলি করিয়ে এনেছে। গত আট দিন ধরে সে ওই মেয়ের সাথেই আছে। আর কতদিন আমি এসব সহ্য করব? আমি কীভাবে বাঁচব?’
‘একটু ধৈর্য ধরো, মেয়ে আমার। একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভালোবাসা দিয়ে ওকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করো।’
‘আম্মা, আমার কি হৃদয় বলে কিছু নেই? আমার কি অনুভূতি নেই? আমাকে ফেলে এভাবে চলে গেছে সে, তাকে আমি স্বামী হিসেবে আর সম্মান করতে পারছি না। তাকে দেখলে আমার শরীর ঘৃণায় ভরে যায়। ভালোবাসা তো অনেক দূরের কথা। আমাকে তার তালাক দিতে হবে না- আমি তার কাছ থেকে তালাক নেব। ওই বাড়িতে আমি আর যাব না।’
‘মেহের, এসব তুমি কী বলছ? খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। সে পুরুষমানুষ, আর একটুখানি কাদায় পা দিয়ে ফেলেছে, কিন্তু পানি পেলেই কাদা ধুয়ে ফেলবে আর তোমার ঘরে ফিরে আসবে, তার গায়ে তখন কোনো দাগই থাকবে না। পুরুষের গায়ে কখনো দাগ লাগে না।’
মেহের এসব কথার জবাবে কিছু বলার আগেই আমান কথা কেড়ে নিল। ‘দেখেন, আমাদের সামনে সে কেমন ব্যবহারটা করছে। স্বামীর সামনেও নিশ্চয়ই এইভাবেই কথা বলে। আর এই কারণেই ওর স্বামী রেগে চলে গেছে।’ একটু থেমে আমান গলার স্বর নিচু করে বলল, ‘এই বাড়ির বউরা যদি এই ধরণের আচরণ শিখে ফেলে তাহলে তো দারুণ হবে, তাই না?’ মেহরুনের দুঃখ দ্রুত বদলে গিয়ে রাগে আর তারপর হতাশায় পরিণত হলো।
‘তুমি খুব ভালো যুক্তি দিচ্ছো, আন্না। আল্লাহ তোমাকে সুস্থ রাখুন। এটা ঠিকই: আমিই খারাপ মানুষ। বুঝতে পারছি আমার কোথায় ভুল হয়েছে। আমি বোরখা ছাড়া বাইরে যাইনি। আমাকে সে বোরখা ছেড়ে দিতে বলেছিল, আর নাভির নিচে শাড়ি পরে তার হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে বলেছিল। কিন্তু আপনারা আমাকে বোরখা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন, আমাকে এমনভাবে বড় করেছেন যেন আমি মাথা থেকে শাড়ির আঁচলও খসে পড়তে না দেই, তাই না? এখন যদি আমি পর্দা ছাড়া চলাফেরা করি আমার নিজের কাছে উলঙ্গ মনে হয়। আপনারা আমার ভিতরটা আল্লাহর ভয় দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন। আমি তার কথা মতো চলতে রাজি হইনি, তাই সে এমন একজনের সাথে গিয়ে মিশেছে যে তার ইচ্ছার সুরে নাচে। আপনারা সবাই এখন ভয় পাচ্ছেন, আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে দিলে আপনাদের উপর আমি একটা বোঝা হয়ে যাব, এই কারণে আপনারা আমাকে সহ্য করতে বলছেন। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব না। ওই জীবন্ত দোজখে থেকে পোড়ার চেয়ে আমি বরং আমার বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও কুলির কাজ করব। আপনাদের সবার ঘাড়ে আমি বোঝা হবো না, একদমই বোঝা হবো না।’
‘ফল কি কখনো লতার বোঝা হয়, মেহের? বাজে কথা বলো না,’ তার মা প্রতিবাদ করেন।
‘আম্মা, ওকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে ভালো করে বোঝান, ওকে কিছু খেতে দেন,’ গম্ভীরভাবে তার বড় ভাই বলল। ‘দশ মিনিটের মধ্যে আমরা চিকমাগালুরে রওনা হবো। যদি বাস থাকে তাহলে বাসে যাব। বাস না থাকলে আমরা ট্যাক্সি নেব। ওর কথায় আমরা নাচতে পারব না।’
‘আপনাদের বাড়িতে আমি এক ফোঁটা পানিও খাবো না। আমি চিকমাগালুরেও যাব না। আপনারা যদি আমাকে জোর করে ওখানে নিয়ে যান, আমি কথা দিচ্ছি আমার গায়ে আমি আগুন ধরিয়ে দিব।’
‘এটা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি, মেহের। যারা মরতে চায় তারা কখনো মরার কথা বলে বেড়ায় না। কিন্তু তোমার যদি এই পরিবারের মানসম্মান নিয়ে সামান্যতম চিন্তা থাকত, তাহলে তুমি এখানে না এসে ওটাই করতে। যে বাড়িতে তোমার পালকি যাবে, সেই বাড়ি থেকেই তোমার খাটিয়া বেরোবে। এটাই একটা ভদ্র মেয়ের জীবন। হাইস্কুলে পড়ুয়া একটা মেয়ে আছে তোমার, দুটো ছোট বোন আছে যাদের বিয়ের বয়স হয়েছে। তোমার একটা ভুল পদক্ষেপ তাদের ভবিষ্যতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তুমি চাইছ আমাদের তোমার ছেলেমানুষি কথা শুনতে হবে , তোমার স্বামীর সাথে ঝগড়া করতে হবে, কিন্তু আমাদেরও তো বউ বাচ্চা আছে। তাই আমি বলছি, তুমি বাড়ির ভিতরে যাও, কিছু খাওয়াদাওয়া করো।’ ছোট ভাইয়ের দিকে ঘুরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বড় ভাই আবার তার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। বলল, ‘আম্মান, দৌড়ে গিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আয়। আর তুমি মেহের, তোমার বাচ্চারা অথবা প্রতিবেশীরা যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে বলবে ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে তুমি হাসপাতালে গেছিলে, অথবা অন্য কিছু বানিয়ে বলো। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলে কখন?’
কিছু বলল না মেহরুন।
‘এখন সাড়ে নটা বাজে,’ আমান বলে। ‘সে এসেছে নয়টায়। তিন ঘন্টার রাস্তা। নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে সকাল ছয়টায় বের হয়েছে। আমরা যদি এই মুহূর্তেই বেরিয়ে যাই তাহলে সাড়ে বারোটার মধ্যে পৌঁছাতে পারব।’
মেহের যেখানে বসেছিল সেখান থেকে নড়ল না। তার মা আর ছোট বোনেরা পালাক্রমে তাকে কিছু খেতে অনুরোধ করতে থাকে, কিন্তু সে খাবারের একটি গুঁড়ো অথবা এক ফোঁটা পানিও মুখে দিল না। ট্যাক্সি যখন এলো, সে কারও সাথে কথা বলল না। ঘরের বাইরে বেরিয়ে শিশুটিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে থাকল। পাশে থাকা বড় ভাইদের কাউকেই সে বিদায় জানাল না। শেষ কয়েকটি পা ফেলার সময় সে পিছনে ফিরে তাকাল যে বাড়িতে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তার দুই চোখে অশ্রু ভরে উঠেছে। ঘরের মধ্যে তার বাবা বুক চেপে ধরে কাশছে। তার মা কাঁদছে, একবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে তারপর তার স্বামীর দিকে, স্বামীকে শুইয়ে দিয়ে বাতাস দিচ্ছে, জল ছিটাচ্ছে, আর আপনমনে বলল, ‘আল্লাহ, আমি যদি আমার সারাজীবনে একটুও পুণ্য করে থাকি, কোনো ভালো কাজ, কোনো সওয়াব অর্জন করে থাকি, তাহলে আমার মেয়ের সাজানো সংসার যেন ঠিক থাকে।’
আমান গাড়ির দরজা খুলে ধরেছে। মনের মধ্যে অসন্তোষ চাপা দিয়ে মেহরুনকে চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করল গাড়িতে উঠে বসতে। চাপা ক্রোধে বিড়বিড় করছে মেহরুন। আগে তার খুব গর্ব ছিল, মাঝে মাঝে সে বড় ভাইদের নিয়ে অহংকার করত। স্বামী এনায়েতের উপর যখন সে রেগে যেত, বলত, ‘আমার ভাইরা শের-ই-বাবরের মতো দাঁড়িয়ে আছে, তুমি যদি আমার সাথে এই ধরণের ব্যবহার করতে থাকো তাহলে একদিন তারা তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে, হুশিয়ার!’ কিন্তু তার এই গর্ব এখন সম্পূর্ণভাবে ধুয়ে গেছে। ভাইদের কথা তার কানে বাজছে: ‘আমাদের পরিবারের মানসম্মান রক্ষা করার বুদ্ধি যদি তোমার থাকত, তাহলে তুমি আগুনে পুড়ে মরতে। আমাদের এখানে আসা তোমার উচিত হয়নি।’
গাড়িতে ওঠার সময় মেহরুন বাড়িটার দিকে ফিরে তাকায়নি, তাই জানালা থেকে উঁকি মেরে দেখা মাকে দেখতে পেল না, পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিতে থাকা বোনদের দেখল না, এমনকি তার ভাবীদেরও না, যারা সম্ভবত ঘরের ভিতরে কাজকর্মে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু তার ঘোমটার নিচে মুখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। গাড়িতে বসে সে ঠোঁট কামড়ে ধরল আর ছোট ছোট ফোঁপানিগুলো গিলে ফেলতে লাগল।
গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটছে। তারা কেউই কথা বলছে না। আমান সামনের সিটে মহল্লার ড্রাইভারের পাশে বসেছে। মহল্লার একটা লোকের সামনে কেউ পারিবারিক গোপন বিষয় আলোচনা করতে পারে? তাদের যাত্রা নীরবে চলতে থাকে। এনায়েতের প্রেম ও কামলালসার খেলায় মেহরুন একটা গুটি হয়ে ডুবে ছিল ষোল বছর। আর ষোল বছর পরে এনায়েত তার নারীত্বকে অপমান করেছে, বলেছে, ‘তুমি একটা লাশের মতো পড়ে থাকো। তোমার কাছ থেকে আমি কী সুখ পেয়েছি?’ মেহরুনকে সে উপহাস করে বলেছে, ‘আমি তোমাকে কী দেইনি – কাপড়, খাওয়া? আমাকে থামাতে আসবে কে, আমি এমন এক নারীর কাছে যাই যে আমাকে খুশি করতে পারে।’
মেহরুন পুরোটা পথ বাইরের গাছ, দৃশ্য অথবা রাস্তা— কিছুই দেখেনি। গাড়িটা আচমকা থেমে গেলে সে উদাসীনভাবে চোখ তুলে বাইরে তাকাল, বাড়িটা চোখে পড়ল, যেটাকে সবাই তার বাড়ি বলে। শুকনো মুখের এক অল্পবয়সী মেয়ে বাড়ির দরজা থেকে ছুটে এসেছে গাড়ির কাছে। মেয়েটা বলল, ‘অবশেষে, আপনি ফিরে এসেছেন আম্মি। আমি খুব চিন্তায় ছিলাম।’ মায়ের কোল থেকে সে বাচ্চাটা তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে আবার বাড়ির ভিতরে দৌড়ে চলে গেল।
মেহরুন ধীর পায়ে বাড়িতে ঢুকল। বাড়িটা খালি খালি লাগছে। বাকি বাচ্চারা স্কুলে চলে গেছে, আর তার ষোল-বছর-বয়সী মেয়ে সালমা, মায়ের সাথে যে নিজেও মায়ের যন্ত্রণা অনুভব করে দুঃখী হয়েছে, মেহরুন চলে যাবার পর বাড়িতে আজ সে-ই সবার বড় ছিল। সালমা তার ভাইবোনদের স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে ওর মায়ের ফেরার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। মায়ের সাথে মামাদের দেখে সালমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মামাদের দেখে সে বেশ উত্তেজিত বোধ করছে। সে ভাবল, মামারা নিশ্চয় অন্য মহিলাটার চুল ধরে টেনে বের করে দিবে, আর মহিলাকে তাদের জীবন থেকে তাড়িয়ে দেবে। হরিণের মতো দ্রুত গতিতে ছুটছে সালমা, মামাদের নাস্তা দিয়েছে, চায়ের পানি ফুটাচ্ছে।
মেহরুন তার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। সালমা ভেতরে ঢুকে মায়ের গাল থেকে অশ্রু মুছে দিল, কিছু খাবার মুখে তুলে দিল, আর অবশিষ্ট খাবারের প্লেট নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।
সালমা দৌড়ে আবার শোবার ঘরে গেল। ‘আম্মি, আম্মি, আব্বা এসেছে।’ মেহরুন তার কথা না শোনার ভান করে নিজেকে ঢেকে রাখা কম্বলের ভিতরে আরও ডুবে গেল। সালমা লিভিংরুমে চলে যাবার পর মেহরুনের মাথার শিরাগুলো থপথপ করে লাফাতে শুরু করল। সালমার মামারা ঘরের দাওয়ায় চলে গেছে। সালমা পুরুষদের কথা শুনতে পাচ্ছে, তাদের কথাবার্তা, হাসি, সালাম।
‘আরে, ভাইয়া! আপনি কখন এসেছেন?’ এনায়েত জিজ্ঞেস করছে।
‘এখনই এলাম। তুমি কেমন আছো?’
‘ওহ, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আর সব আপনাদের দোয়া।’
আমানের কণ্ঠস্বর: ‘কোথায় গিয়েছিলেন এনায়েত ভাই?’
‘এই তো এখানেই। এই সেই কিছু কাজ, এটা ওটা আরকি – জানেনই তো কেমন চলে দিনকাল। সবচেয়ে বড় কথা ঘুম থেকে ওঠার পর আমরা তো ঘরে বসে থাকতে পারি না। সালমা,’ সে ডাকে, ‘সালমা, তোর আম্মি কোথায়, দেখ কে এসেছে। আম্মিকে বাইরে আসতে বল।’
ঘরের ভিতর থেকে কোনো শব্দ হলো না। ‘আশ্চর্য তো, কোথায় গেল,’ এনায়েত বলে। ‘ও নিশ্চয়ই বাচ্চা নিয়ে ঘরের ভিতরে আছে, আমি ওকে ডাকছি, আপনারা একটু থাকেন।’ ঘরের ভিতরে এসে সালমাকে দেখতে পেল, নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘এরা কখন এসেছে? তোর আম্মি কই?’ এনায়েতের মনে সন্দেহের একটা সুতো ছড়াতে আরম্ভ করেছে।
‘মামারা এখনই এসেছে, আম্মি এখনও ঘুমাচ্ছে,’ চালাকি করে উত্তর দিল সালমা।
এনায়েত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
‘এখনও ওঠেনি? কী হয়েছে তার?’ শোবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে এনায়েত। মেহরুনের গুটুসুটি মেরে শুয়ে থাকা আর ঘুমাতে দেখে সে বিরক্ত হয়েছে। তার কাছে মেহরুনের কিছুটাও গুরুত্ব থাকার একমাত্র কারণ সে তার সন্তানদের মা। যদিও ইচ্ছে করছিল, কিন্তু পা দুটো তাকে ঘরের ভিতরে টেনে নিতে পারল না।
চোখ বন্ধ করে মেহরুন কল্পনা করেছিল কীভাবে তার স্বামী দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। স্বামীর পোশাক, সিগারেটের দুর্গন্ধ, ঘামের গন্ধ, বুড়িয়ে যাওয়া শরীর, বড় বড় চোখ। যে পুরুষ তার প্রতিটি নার্ভে ছাপ রেখে গেছে, আজ সে তার অপরিচিতজন। শক্ত করে কম্বল জড়িয়ে ধরে থাকল মেহরুন, লোকটার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে সে।
‘সালমা, এখানে আয়। তোর মাকে বল এইসব নাটক বন্ধ করতে। ভাইদের এখানে ডেকে এনেছে আমাকে উপদেশ দেওয়াতে, এসব করলে সে নিজের গলায় ফাঁস লাগানোর চেষ্টা করবে। আমি শুধু একদমে বলব, এক দুই তিন, ব্যস, খেলা শেষ, বল তোর মাকে। আর তাকে বলে দে, তার তালাকের পরে সে ছোট বোন আর নিজের মেয়েদের বিয়ে দিতে পারবে কিনা। তাকে বল, এই বাড়িতে সে মেহমানদের সামনে আমার পরিবারের সম্মান নষ্ট করছে। তাকে বল, তোর মাকে কথাগুলো পরিষ্কার করে বল। ভাইদের সামনে গিয়ে দেখা করে হাসিমুখে কথা বলুক; তোর মাকে জিজ্ঞেস কর মুরগি না খাসির মাংস আনতে হবে, দুপুর প্রায় হয়ে গেছে, তোর মাকে বল জলদি রান্নার আয়োজন শুরু করতে।’ সালমা সেখানে ছিলও না, কিন্তু এনায়েত তার যা যা বলার ছিল সব থুথু ছিটিয়ে মুখ থেকে বের করে দিয়েছে, কল্পনা করে নিয়েছিল সালমা সেখানে আছে।
একটা ঘরে এনায়েত আর মেহরুনের ভাইয়েরা এমনভাবে আলাপ করে যাচ্ছে যেন কোনো সমস্যাই হয়নি। তারা কফির দাম, কাশ্মীরের নির্বাচন, পাড়ার এক বৃদ্ধ দম্পতির হত্যার তদন্ত, মহল্লার এক মুসলিম মেয়ে যে এক হিন্দু ছেলের সাথে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেছে, এইসব ওইসব নিয়ে তারা কথা চালিয়ে গেল। তাদের কথা চলতেই থাকল যখন প্রেসার কুকারের সিটি বেজে উঠল, ব্লেন্ডার ঘুরল, মশলার শক্তিশালী মনকাড়া গন্ধ ভেসে এলো, মুরগি নিয়ে আসা হলো, আর যখন খাবার প্রস্তুত হয়েছে, কারণ মেহরুন রান্না করেছে, আর সালমা দৌড়াতে থাকল তাদের সবাইকে দুপুরের খাবার পরিবেশন করতে। মেহরুন রান্নাঘর থেকে একবারই বেরিয়ে এসেছিল, কেবল সামান্য সময়ের জন্য।
পেট পুরে খাওয়ার পরে, মুখে তাম্বুল গুঁজে, মেহরুনের ভাইয়েরা যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। চলে যাওয়ার আগে আমান রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘একটু বুদ্ধি খাটিয়ে নিজের সংসারে সবকিছু সামলাও। সামনের সপ্তাহে আবার এসে তোমাকে দেখে যাব। কয়েকদিন সে এইরকম করবে, তারপর একাই ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। মেয়েদের কতরকম সমস্যা হয়- মাতাল স্বামী পায়, শাশুড়ি মারধর করে। আল্লাহর শুকরিয়া যে তাদের তুলনায় তুমি ভালো আছো। সে একটু দায়িত্বজ্ঞানহীন, এটুকুই। তোমাকেই সংসারের দায়িত্ব নিয়ে এসবের মধ্যে সামলে চলতে হবে।’ মেহরুনের ভাইরা চলে গেল, আর রাস্তায় গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যেতেই এনায়েতও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
মামারা তাকে কোনো সান্ত্বনাও দেয়নি অথবা সাহায্যও করেনি। সালমা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের দুঃখে সে থরথর কাঁপছে। বাবা যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। বাড়িটা যেন বিষাদের এক কালো চাদরে ঢেকে গেছে। আর যখন ছোট ছেলেমেয়েগুলো স্কুল থেকে ফিরে এলো, তারা এই কালো চাদরটা তুলে দিতে পারল না। সবারই কিছু নিজস্ব কাজ আছে, সবাই নিজের বোঝা নিয়ে ব্যস্ত।
বিকেলের আলো কমতে শুরু করলে, ঘরের চারপাশে বাতি জ্বলে উঠল। কিন্তু মেহরুনের হৃদয়ের বাতি অনেক আগেই নিভে গেছে। কার জন্য বেঁচে থাকবে সে? কী মানে আছে বেঁচে থাকার? দেয়াল, ছাদ, থালা, বাটি, চুলা, বিছানাপত্র, বাসনকোসন, সামনের উঠানে গুলাব গাছ—এগুলোর কোনটাই তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। নিজের আশেপাশে মেহরুন এমন একজোড়া নিস্তেজ চোখ দেখতে ব্যর্থ হলো যারা তাকে পাহারা দিচ্ছে। বড় মেয়ে সালমা চাইছিল নিজেকে বইয়ের মধ্যে সমাহিত করতে; এখন তার আসন্ন এসএসএলসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার কথা। কিন্তু নাম না জানা এক বিরাট উদ্বেগ তাকে অস্থির করে রেখেছে, ক্রমাগত সে তার মাকে দৃষ্টির পাহারায় রেখেছে।
রাতের নিস্তব্ধতায় মেহরুণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। সময়টা তার জীবনের মতোই গভীর কালো। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। কেবল সালমা এখনো জেগে, ড্রয়িংরুমে পড়াশোনা করছে, তার চোখ প্রহরী হয়েছে মায়ের ঘরের দিকে।
মেহরুনের ঘুম উধাও হয়ে গেছে। সে ভাবছে: বিয়ের আগে তার নিজের বাড়িতেও লড়াই কি সহজ ছিল? এনায়াতের সাথে তার বিয়ে হয়েছিল বিকম দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার এক মাস আগে। সে কেঁদেছিল, তাকে পরীক্ষা দিতে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল, কিন্তু তার অনুরোধে সবাই কানে তালা লাগিয়ে ছিল। বিয়ের এক সপ্তাহ বা এমন একটা সময়ের পরে মেহরুন একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে পরীক্ষার দেয়ার ব্যাপারে স্বামীর সাথে কথা বলেছিল। এনায়েত হেসেছিল, তাকে ‘লাভ’, ‘ডার্লিং’, ‘আমার জান’ ইত্যাদি ডেকেছে। আর বলেছিল, ‘তুমি যদি এখানে না থাকো, আমার কি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে না?’ মেহরুন বিশ্বাস করেছিল, সে পাশে না থাকলে তার স্বামীর শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সে খুশি হয়েছিল। স্বামীর প্রতিটি ইচ্ছা পূরণ করেছে সে, আর সে ছিল তার স্বামীর হৃদয়ে আলো জ্বালানোর বাতি।
মাত্র এক বছর আগে শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর মেহরুন অবশেষে স্বামীকে সম্পূর্ণরূপে নিজের করে পেয়েছিল। ননদরা সবাই তখন নিজেদের স্বামীর বাড়িতে চলে গেছে; দেবর ও ভাসুররা যার যার নিজের পথে চলে গেছে। একটা অনেক দিনের স্বপ্ন, মেহরুনের নিজের একটা বাড়ি হবার স্বপ্ন, সেটাও পূরণ হয়েছে। কিন্তু এখন যখন সে এটা পেয়েছে, এতদিনে তার মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে, হাতের শিরাগুলো চামড়ার ওপরে ফুটে উঠেছে, চোখের নীচে একটা পাতলা কালো ছায়া পড়েছে, গোড়ালি দুটো ফেটে গেছে, আর তার ভাঙা অসমান নখের নীচে স্থায়ীভাবে ময়লা জমে গেছে, তার চুল পাতলা হয়ে গেছে- কিন্তু এসবের কিছুই সে লক্ষ্য করেনি। আর হয়তো এনায়াতও লক্ষ্য করত না, যদি না তার অ্যাপেনডিক্সের অস্ত্রোপচার না হতো, আর সেই নার্স, যে একটি বেসরকারি হাসপাতালে খুব কম বেতনে অনেক কাজ করে, যে নার্সমেয়েটা চোখে হাজার হাজার স্বপ্ন নিয়ে হেঁটে যেত অথবা সেই মেয়েটা হয়তো বাতাসে ভেসে বেড়াত -কেউ জানে না– মেয়েটার উজ্জ্বল ত্বক ও মধু-রঙের চোখ যেকাউকে ঘূর্ণির মতো টেনে নিতে পারে, সেই নার্স যার বয়স ত্রিশের কোঠায় পৌঁছে যাচ্ছে, আর যে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে ও স্বপ্ন পূরণ করতে যেকোনো কিছুই করতে প্রস্তুত ছিল — মেয়েটার সাথে এনায়েতের যদি কখনো দেখা না হতো।
এনায়েত এই নার্সকে কখনো ‘সিস্টার’ ডাকেনি। হাসপাতালে কাটানো দিনগুলোর প্রথম দিন থেকেই সে তাকে নাম ধরে ডেকেছে।
আর এরপর এনায়াত সেই গর্ভকে অপমান করেছে যে গর্ভ তাকে তার রক্তের অনেকগুলো সন্তান উপহার দিয়েছে। সে মেহরুনের ঢিলা পেট আর ঝুলে পড়া স্তনের জন্য তাচ্ছিল্য ও তিরস্কার করেছে যেগুলো তাদের সন্তানদের ক্ষুধা মিটিয়েছে। এনায়েত মেহরুনের আত্মাকে পোশাকহীন নগ্নও অনুভব করিয়েছে। একদিন সে বলেছিল, ‘তুমি আমার মায়ের মতো,’ এই শব্দগুলো দিয়ে মেহরুনকে সে জীবিত অবস্থায় নরকের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। এই কথাগুলো উচ্চারিত হবার পর থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত মেহরুন যতদিন এই বাড়িতে খাবার খেয়েছে, খাবারের প্রতিটি গ্রাস তার কাছে পাপের মতো মনে হয়েছে। তার মনের মধ্যে অবিরাম নিজের বাড়িতে এক অপরিচিতজন হয়ে ওঠার অনুভূতি ঘুরে বেরিয়েছে, আর অপমানের আগুন তাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে, আর তাই সে নিজের পরিবারের কাছে সাহায্য চেয়েছিল।
রাত গভীর হতে থাকে। মেহরুনের হৃদয়ের উত্তেজনাও তীব্রতর হচ্ছে। আগে কখনো সে এমন একাকীত্ব অনুভব করেনি। জীবনের প্রতি সে কোনো আকাঙ্খা অনুভব করছে না। বিছানায় উঠে বসল মেহরুন। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার কেউ নেই। তার সাথে খুনসুটি করার, আলিঙ্গনে বাঁধার, চুমু খাওয়ার মতো কেউ নেই। যে মানুষটা এই কাজগুলো করত, এখন সে অন্য কারও। মেহরুনের মনে হতে থাকে তার এই জীবনের বুঝি কোনো সমাপ্তি নেই। এমনকি পিছন থেকে আসা জোরালো শব্দও তাকে বিচলিত করল না। সে জানে একটা ফ্রেমে বাঁধা ছবি দেয়াল থেকে পড়ে গেছে, কাচ ভেঙে গেছে, ফ্রেমটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে আর ছবিটি মেঝেতে পড়ে গেছে। কিন্তু তার মধ্যে এক ধরণের উদ্বেগ বাসা বেঁধেছে আর নিজের ভিতরের বিশৃঙ্খলা মিটানোর কোনো ইচ্ছাও তার নেই। ধীরে ধীরে সে বিছানা থেকে নেমে গেল। দীর্ঘ সময় শিশুটার দিকে তাকিয়ে রইল। আর তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরে তার ছোট বাচ্চাগুলো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।
যখন সে পা টিপে টিপে ড্রয়িংরুমে ঢুকেছে, সালমাকে সেখানে দেখতে পেল। যেখানে বসে সালমা পড়ছিল, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে, মাথাটা টেবিলের উপর হেলে আছে। ঘুমন্ত মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মেহরুন কাঁপতে শুরু করে। সে ভেবেছিল তার সমস্ত অনুভূতি মরে গেছে, কিন্তু সালমার দিকে তাকাতেই তার ভেতরে যে অসম্ভব আবেগ তাকে উদ্বেলিত করল, সেই ঢেউ তাকে ভেঙে পড়তে বাধ্য করছে। নিজের মেয়েকে স্পর্শ করার তীব্র ইচ্ছা দমন করে মেহরুন মনে মনে বলল, ‘ও আমার প্রিয় কন্যা, তোমাকে এই বাচ্চাদের মা হতে হবে।’
তার পা দুটো তাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। দরজা খুলে সামনের উঠোনে পা রাখল। বাগানের যে কয়েকটি গাছ সে পরিচর্যা করত, সেগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে কাঁদছে। মনে হচ্ছে তারা মেহরুনের নেয়া সিদ্ধান্তে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছে। ঘরের ভিতরে ফিরে এলো সে, পিছনে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিয়েছে। মেহরুন রান্নাঘরে গেল, কেরোসিনের গ্যালন হাতে তুলে নিল আর বাড়ির সবখানে ঘুরে দেখতে লাগল এই তরলটুকু কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে ঢেলে দেয়া যায়। ড্রয়িংরুমে ফিরে আসার আগে সে আরেকবার থামল তার ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাদের দেখতে।
সে সালমার দিকে তাকাল না।
দ্রুত পায়ে মেহরুন রান্নাঘরে গেল। ম্যাচের বাক্সটা হাতে নিল। ডান হাতে বাক্সটা শক্ত করে ধরে খুব সাবধানে সামনের দরজার ছিটকিনি খুলে আবার উঠানে পা রাখল। রাতের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে সে নিশ্চিত হয়ে গেল, এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই, কেউ তাকে চায় না। নিজের গায়ে কেরোসিন ঢালার সময় সে এসব ভাবতে থাকে। মেহরুন এমন এক শক্তির কবলে পড়েছে যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। চারপাশে তাকাল সে, কিন্তু কোনো শব্দ তার কাছে পৌঁছাল না, কোনো স্পর্শ সে অনুভব করতে পারল না, কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট নেই তার মনে, কোনো সম্পর্কই আজ তাকে গাঁথতে পারছে না। সে তার চেতনার বাইরে চলে গেছে।
কিন্তু তখন ঘরের ভিতরে সবকিছুই ঘটছিল। সেখানে বাচ্চার ক্ষুধার চিৎকারে সালমার ঘুম ভেঙে গেছে। সালমা বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ‘আম্মি, আম্মি’ বলে ডাকতে শুরু করেছে। সালমা ছুটে গেছে তার ভাইবোনেরা যেখানে ঘুমাচ্ছিল সেখানে। তারপর ঘরের ভিতর সবখানে সে মাকে খুঁজছে, এমনকি ঘরের দরজা খোলা দেখা আর উঠোনে দৌড়ে যাওয়া, ঝাপসা অন্ধকারে তার মায়ের ছায়া দেখা ও কেরোসিনের গন্ধ পাবার আগে থেকেই সালমা তার মাকে খুঁজছিল। কিছু চিন্তা না করেই সে বাচ্চাটা কোলে নিয়ে দৌড়ে উঠোনে এগিয়ে গেল, মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তার মা, হাতে দেশলাইয়ের বাক্স, যে মেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে তার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকাল, যেন সে অন্য কাউকে প্রত্যাশা করেছিল। বাচ্চাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে সালমা চিৎকার করে উঠল, ‘আম্মি! আম্মি! আমাদের রেখে চলে যাবেন না!’ মায়ের পা জড়িয়ে ধরেছে সে। সালমা ফোঁপাচ্ছে, আর ছোট্ট শিশুটি মাটিতে কাঁদছে। মেহরুন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আর মেহরুন সেই অদ্ভুত শক্তির হাত থেকে মুক্তি পেতে লড়াই করছে যা তাকে গভীরভাবে ঘিরে রেখেছে। মেহরুনের হাত থেকে ম্যাচের বাক্সটা পড়ে গেল। সালমা এখনও তার মায়ের পা জড়িয়ে আছে। সে বলছে, ‘আম্মি, আপনি শুধু একজনকে হারিয়েছেন বলে আমাদের সবাইকে সৎ-মায়ের দয়ার ওপর ছুড়ে ফেলবেন? আব্বার জন্য আপনি মরতে প্রস্তুত, কিন্তু আমাদের জন্য কি আপনার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব না? আপনি কীভাবে আমাদের সবাইকে এতিম করে দিতে পারেন, আম্মি? আমরা আপনাকে চাই। আপনাকে আমাদের প্রয়োজন।’ কিন্তু কথার চেয়েও বেশি কিছু ছিল সালমার স্পর্শ, যা মেহরুনকে প্রভাবিত করেছে।
কাঁদতে থাকা বাচ্চাকে তুলে নিয়ে মেহরুন সালমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। অনুভব করল যেন কোনো বন্ধু তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, স্পর্শ করছে ও বোঝাচ্ছে। মেহরুনের চোখ ভারী হয়ে এলো। যেভাবে রাতের অন্ধকার গলে যাচ্ছে, সেইভাবে সে শুধু এটুকুই বলতে পারল ‘ওরে আমার মেয়ে, আমাকে মাফ করে দে।’
No comments:
Post a Comment