সদর দরজার ওপারে খাঁজকাটা গ্রিলের গেট, তার সামনে বাঁশ দিয়ে কাঠামো তৈরি করে তাতে লাল-হলুদ-গোলাপি ঝলমলে কাপড় জড়িয়ে তৈরি হয়েছে সুদৃশ্য প্রবেশদ্বার । সেই প্রবেশদ্বারের উপরে আটকানো সবুজ প্রজাপতির নকশাই বলে দিচ্ছে, আজ এ বাড়িতে কারুর বিয়ে । চৈত্র মাস পেরিয়েছে সদ্যই । নীল ষষ্ঠীতে নিকোনো উঠোনে আজ আবার নতুন করে গোবরছড়া দেওয়া হয়েছে । বৈশাখের আজ প্রথম বিয়ের তারিখ । উঠোনের কোণে যেখানে তুলসীতলার উপরে বসানো সরা থেকে বিন্দু বিন্দু জল পড়ছে তুলসীগাছের উপর, তার ঠিক পাশেই ইঁটের উপর ইঁট গেঁথে, তাতে মাটি লেপে তৈরি করা হয়েছে, দুই বিশাল অস্থায়ী উনুন । নীল তেরপলের চাঁদোয়ার নিচে এক কোণে বসে হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে উনুনে আঁচ দেওয়ার কয়লা ভাঙছে একজন । ট্রাক্টর থেকে হাতে হাতে নামানো হচ্ছে রান্নার কড়াই, খাবার মজুত করার গামলা, নৌকা, বালতি । নামানো হচ্ছে সাদা রং করা লোহার চেয়ার, নড়বড়ে লম্বা, টানা টেবিল । উঠোনের অন্যদিকে, ভাড়া করে আনা বক্সে বাজছে কিশোর, আশা, রফির গান । একে একে বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে এসে পড়েছে আত্মীয়রা ।
নব্বইয়ের দশকটা আমরা যারা গ্রামে কাটিয়েছি, আমরা বোধহয় প্রত্যেকেই রিলেট করতে পারব বিয়েবাড়ির সকালের এই টুকরো ছবিগুলির সাথে । এ হলো সেই সময়কার কথা যখন ক্যাটারিং সার্ভিস কী, গ্রামের লোকেরা জানতই না । বিয়ের দিন সকাল থেকে রাঁধুনি বামুন ঠাকুর নিজের সঙ্গে টহুলেটিকে নিয়ে বাড়িতে আসতেন, সঙ্গে আনতেন দুই হালুইকরকে । বৌভাতের দুপুর পার করে, আত্মীয় স্বজনদের দুপুরের ভোজ খাইয়ে আর রাস্তার জলখাবার বেঁধে দিয়ে তবে বিদেয় নিতেন তারা ।
এই জীবনে দেশে এবং বিদেশে বহু জায়গায় বহু বিয়েবাড়িতে আমন্ত্রিত হয়েছি । অঞ্চলভেদে বিয়েবাড়ির ভোজের বৈচিত্র্যও কম দেখিনি । কিন্তু আমাদের বাঙালি বিয়েবাড়িতে বিয়ের ভোজকে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়, তেমনটি আমি কোথাও দেখিনি । বিয়েবাড়ি উপলক্ষে দু-দুটি প্রীতিভোজের আয়োজন, খুব কম জায়গাতেই দেখা যায় আমাদের এই বঙ্গদেশ ছাড়া । তবে সত্যি বলতে কী, ব্যক্তিগত ভাবে বিয়ের রাত্তিরের ভোজের তুলনায় আমায় বরাবর বেশি আকর্ষণ করে বিয়ের দুপুরের ভোজ, যাকে আমরা ঘরযজ্ঞি বলি ।
আমার বেড়ে ওঠা গ্রামে । জীবনের প্রথম পনেরো বছর গ্রামে কাটিয়ে, মফঃস্বলবাসী হলাম যখন, হঠাৎই লক্ষ্য করলাম গ্রামের চাইতে আমাদের এই কোলকাতা ঘেঁষা মফঃস্বলে প্রীতিভোজের আয়োজনে কিন্তু বেশ তারতম্য আছে । গ্রামে যখন বিয়ের সন্ধেয় বরযাত্রীদের জলখাবার মানেই ছিল কচুরি, তরকারি, মিষ্টি ; আমাদের এই মফঃস্বলে তখন সেই জলখাবারের প্যাকেটে জায়গা করে নিয়েছে মুরগির প্যাটিস, কেক ও অন্যান্য সন্দেশ । বিয়েবাড়ির সন্ধেয় যে ভোজবাড়ির সামনে একটি ফুচকার গাড়ি থাকবে এবং সেই ফুচকার গাড়ি থেকে দেদার ফুচকা খাওয়া যাবে ইচ্ছেমতো, এও আমি জানতে পারি এই মফঃস্বলে আসার পরই ।
কিন্তু যা বদলায়নি, তা হলো ঘরযজ্ঞির খাবার ।
আমার পরিবারে শুভ কাজ যেমন অন্নপ্রাশন, পইতে বা বিয়েতে মাংস ব্রাত্য ছিল বহুকাল । মুরগির মাংস তো বটেই, পাঁঠার মাংসও খুব একটা সমাদৃত ছিল না আমাদের বাড়ির বিয়ের ভোজে । বিয়ে, ভাত কাপড়, বৌভাত, তিনদিনই পুকুরে জাল দেওয়া হত, বা কাছাকাছি শহর থেকে গিয়ে সকাল সকাল মাছ কিনে আনা হত নানারকম । সেই মাছেরই বিভিন্ন পদ রান্না করা এবং খাওয়ানো হত দুপুরে এবং রাতে । এদেশীয় হওয়ার সুবাদে মাছের মধ্যে চিংড়ি মাছের বিভিন্ন পদ আমাদের বাড়িতে হতই, এবং আমাদের রান্নার বামুন ঠাকুর বেশ পারদর্শী ছিলেন চিংড়িমাছের নানা পদ রান্না করতে । আজও বেশ ভালো মনে পড়ে, রান্নাচালায় বসে বামুন ঠাকুরের টহুলেটি ময়দা মাখছে, আর বামুন ঠাকুর নির্দেশ দিচ্ছেন, “ময়দা মাখার সময় যতটা নুন দেবে, তার অর্ধেক দেবে চিনি । এই চিনি মেশালে লুচি কম তেল টানবে । ময়দায় কালোজিরে ছড়াবে খানিক । ময়দা মাখার সময় ওই কালোজিরের সুগন্ধ যেন ভালো ভাবে মিশে যায় ময়দার সাথে” । আমরা ভাইবোনরা উদ্গ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম রান্না চালার সামনে আর দেখতাম, কী ক্ষিপ্রতায় লুচি বেলে ভেজে ফেলা হচ্ছে । সেদিকে নজর করে বামুন ঠাকুর টহুলে কাকাকে নির্দেশ দিতেন, “ওদের একটা করে গরম লুচি দে, সীতারামকে বল তো, বোঁদের গামলাটা এদিকে দিতে” । সীতারামদাদা ছিলেন উড়িষ্যার মানুষ । কী করে যে আমাদের গ্রাম বাংলায় এসে পড়েছিলেন জানা নেই কিন্তু তার হাতে যেন জাদু ছিল । অমন ঠাসা ছানার রসগোল্লা যা মুখে দিলেই মিলিয়ে যেত, অমনটি আমি আর কোথাও খাইনি । বোঁদে, দরবেশ, মালপোয়াও অনবদ্য বানাত সীতারামদাদা । ঝুরো ছানার একরকম পায়েস আমাদের বাড়ির সব অনুষ্ঠানে জায়গা করে নিয়েছিল যে ছানার পায়েস আমি আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠান ছাড়া কোথাও খাইনি ।
No comments:
Post a Comment