Friday, June 13, 2025

বাস্তব শিক্ষা

 



যেখানে লাখ টাকা দিয়ে ফোন কিনলেও সেটা দুই মাস ব্যবহার করার পর আর ভালো লাগে না, সেখানে একটা মেয়ের সাথে সারাজীবন সংসার করা ভালো লাগবে না—এটাই স্বাভাবিক।"

বিয়ের প্রথম রাতে স্বামীর মুখ থেকে এমন কথা শুনলে যেকোনো মেয়ের হয়তো পা থেকে মাটি সরে যেত। কিন্তু আমার তেমন কিছুই হয়নি। আরিফ (আমার স্বামী) বাস্তব কথা বলেছে। যেহেতু আমি বাস্তববাদী মেয়ে, সেহেতু আরিফের এই বাস্তবসম্মত কথাটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
শুধু তাই না, আমার স্বামী বিয়ের প্রথম রাতে আরও বলেছে,
— "আমি কোথায় কী করছি, না করছি, কে কল দিলো না দিলো, কোন মেয়ে-ফ্রেন্ডের বাসায় গেলাম, না গেলাম—এইসব বিষয় নিয়ে আমায় কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। আমার ফোন-ল্যাপটপ সবসময় দূরে থাকবে। কখনো খালি হাতে স্পর্শ করারও চিন্তা কোরো না। এইগুলো পার্সোনাল জিনিস। বিয়ে করেছি মানে এই না যে আমি আমার প্রাইভেসি তোমায় দিয়ে দেবো।"
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম,
— "যা বলেছেন, সব মনে থাকবে। তা এখন যদি লাইট অফ করে দিতেন, তাহলে ঘুমিয়ে যেতাম। লাইট অফ না করে যদি কাছে আসতে চান, তাহলে আসতে পারেন—হাজার হোক, বাসর রাত বলে কথা।"
আমার কথা শুনে আমার স্বামীর মুখটা যেন বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেলো। উনি হয়তো আশা করেননি, উনার এত কঠিন কথাগুলো আমি এত সহজভাবে নেবো…

বিয়ের মাস তিনেক পরের ঘটনা। রাতে সবাই মিলে খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমি শ্বাশুরিকে বললাম,
— "শাবনূর আপা, আপনাকে মাছের তরকারি দেবো নাকি মাংসের?"
আমার কথা শুনে সবার চোখ কপালে উঠে গেলো। শ্বাশুরি আমতা-আমতা করে বললেন,
— "বউমা, তুমি আমায় শাবনূর আপা বলে ডাকছো কেন?"
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— "আসলে আপনাকে মা ডাকতে ডাকতে বোরিং হয়ে যাচ্ছিলাম। আর ডাকতে ভালো লাগছিল না। যেখানে লাখ টাকা দিয়ে ফোন কিনলেও সেটা দুই মাস পর আর ভালো লাগে না, সেখানে আপনাকে তিন মাস মা বলে ডেকেছি—সেটাই তো অনেক। শাবনূর আপা ডাকতে ডাকতে যদি বোরিং লাগে, তাহলে পূর্ণিমা আপা, মৌসুমি আপা কিংবা অপু বিশ্বাস-বুবলী কিছু একটা নামে আপনাকে ডাকবো—যাতে বোরিং না লাগে।"
আমার কথা শুনে শ্বাশুরি বোবার মতো হয়ে গেলেন। উনার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিল না। শ্বশুরের অবস্থা তো আরও খারাপ—মনে হচ্ছিল খাবার উনার গলায় আটকে গেছে, নিচে নামছে না।
আমি শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— "শাকিব খান, আপনার গলায় মনে হয় খাবার আটকে গেছে। আপনি একটু পানি খান। আপনাকেও 'বাবা' বলে ডাকতে ডাকতে বোরিং লাগছিল। তাই চিন্তা করলাম, আপনাকেও আজ থেকে শাকিব খান বলে ডাকবো। এই নামেও বোরিং ফিল এলে জায়েদ খান, হিরো আলম—কিছু একটা বলে ডাকবো।"
এইসব দেখে আমার স্বামী আমাকে হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বললো,
— "তুমি আমার মা-বাবার সাথে ফাইজলামি করছো? আমার মাকে অপু বিশ্বাস, আর বাবাকে হিরো আলম ডাকবে! এইসবের মানে কী?"
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— "ফাইজলামি আমি করছি, নাকি তুমি করছো? বিয়ের প্রথম রাতেই তুমি বলেছিলে, 'লাখ টাকা দিয়ে ফোন কিনলেও সেটা দুই মাস পর ভালো লাগে না, সেখানে একটা মেয়ের সাথে সারাজীবন সংসার করা ভালো লাগবে না—এটাই স্বাভাবিক।' একটা ফোনের সাথে নিজের বিবাহিত বউকে তুলনা করা ফাইজলামি ছাড়া আর কিছু না। সারাজীবন যাকে 'বাবা' বলে ডেকে এসেছো, তাকে এখন 'বাবা' বলে ডাকতে ভালো না লাগলে, অন্য কাউকে আব্বা বলে ডাকবে নাকি?"
আমার কথা শুনে আমার স্বামী মাথা নিচু করে চুপ হয়ে রইলো। আমি আর কিছু না বলে অন্য রুমে চলে এলাম…
সেদিন মাঝরাতে আমার স্বামীর প্রচণ্ড পেট ব্যথা শুরু হলো। আহহ উহহ করতে করতে সারাবাড়ি মাথায় তুলে ফেললো। আমি স্বামীর কানে কানে বললাম,
— "বাবাগো, মা গো বলে চিল্লাও। তারপরেও এই রকম আওয়াজ করো না। একজন পুরুষ মানুষের মুখ থেকে এমন আওয়াজ খুব অশ্লীল শুনায়। আশেপাশের মানুষজন ভুল কিছু ভাববে।"
আমার কথা শুনে স্বামী রেগে গিয়ে বললো,
— "ফাইজলামি না করে তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন দাও!"
— “আমার ফোনে টাকা নাই।"
— "আমার ফোন দিয়ে দাও।"
এটা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম,
— "আমার কাছে তো সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস নাই। খালি হাতে তোমার ফোন স্পর্শ করলে শক লাগবে না? আচ্ছা, এক কাজ করি—রান্নাঘর থেকে কিচেন হ্যান্ড গ্লাভস নিয়ে আসি।"
এই কথা বলে আমি দৌড়ে রান্নাঘর থেকে গ্লাভস আনলাম। কিন্তু গ্লাভস পরার কারণে ফোনের টাচস্ক্রিন কাজ করছে না।
আমার স্বামী তখন বললো,
— "আল্লাহ দোহাই লাগে, গ্লাভস খুলে নাও!"
আমি বললাম,
— "সম্ভব না। বিয়ের প্রথম রাতেই তুমি বলেছিলে, তোমার ফোন যেন আমি খালি হাতে স্পর্শ না করি। এখন যদি খালি হাতে স্পর্শ করি আর শক খেয়ে ম*রে যাই? নিজের সেফটি আগে…"
আমার স্বামী চিল্লাতে চিল্লাতে বললো,
— "এইবারের মতো মাফ করে দাও আমায়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রাইভেসি বলে কিছু থাকবে না। আজ থেকে আমার ফোন মানেই তোমার ফোন। আমার ফোনে কে SMS দিলো, কে কল দিলো—সব তুমি দেখো। এইবার অন্তত ডাক্তারকে কল দাও!"
ড্রয়িং রুমে আমার বাবা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, আমি এবং আমার স্বামী সবাই বসে আছি। এমন সময় বাবা আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে বললেন,
— "বেয়াইনসাব, আমি এসেছিলাম আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে। আসলে সামনের রবিবার ছেলেপক্ষ আমার মেয়েকে দেখতে আসবে।"
এটা শুনে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি অবাক হয়ে বললেন,
— "আপনার মেয়েকে দেখতে আসবে মানে! আপনার তো একটা মাত্র মেয়ে, যে বর্তমানে আমার ছেলের বউ।"
বাবা তখন হালকা গলায় কেশে বললেন,
— "আসলে বেয়াইনসাব, যেখানে লাখ টাকা দিয়ে ফোন কিনলেও সেটা দুই মাস পর আর ভালো লাগে না, সেখানে একটা ছেলের সাথে সারাজীবন সংসার করা ভালো লাগবে না—এটাই স্বাভাবিক। আমার মেয়ের আপনার ছেলের সাথে সংসার করতে ভালো লাগছে না। তাই অন্য জায়গায় বিয়ে দেবো।"
শ্বশুর-শ্বাশুড়ি কিছু বলার আগেই আমার স্বামী আমার বাবার কাছে হাত জোর করে বললো,
— "বাবা, আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। নেক্সট টাইম আপনার মেয়েকে এমন ফালতু কথা জীবনেও বলবো না। আপনার মেয়ে আমায় বাস্তব শিক্ষা দিয়েছে। আপনি আর শিক্ষা দিতে যাবেন না…"
স্বামীর অবস্থা দেখে বাবা আমার দিকে তাকালেন। আমি ইশারায় বাবাকে বুঝিয়ে দিলাম—এইবারের মতো বেচারা স্বামীকে মাফ করে দাও।

No comments:

Post a Comment