উমায়াদ ও আব্বাসী খেলাফতের মধ্যে ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য গভীর এবং তা ইসলামের বিকাশে একটি মোড় ঘুরিয়ে দেয়। উমায়াদের হাতে ইসলামের যে রূপ দেখা যায়, তা ছিল অনেক বেশি রাজনৈতিক ও গোত্রগত ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। তারা ইসলামকে একটি গোত্রতান্ত্রিক কাঠামোর অংশ হিসেবে দেখেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল আরব জাতীয়তাবাদের ছাতায় স্থানীয় গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে পারস্য ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে ক্ষমতা দখল করা। এ কারণে উমায়াদের যুগে ধর্মীয় তাত্ত্বিক বিন্যাস খুব একটা গড়ে ওঠেনি। কুরআনকে তখনও তারা একটি অনুপ্রেরণামূলক ও প্রতীকী পাঠ হিসেবে ব্যবহার করতেন, কিন্তু এর মধ্যমে সুস্পষ্ট আইন বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নির্দেশনা তারা প্রতিষ্ঠা করেননি।
অপরদিকে, আব্বাসী খেলাফতের সময় ইসলামকে একটি সুসংগঠিত ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামোয় পরিণত করার প্রবল চেষ্টা দেখা যায়। উমায়াদের বিপরীতে, আব্বাসিরা নিজেদের শাসনকে কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা হিসেবে নয়, বরং একপ্রকার ধর্মীয় কর্তৃত্বের অধিকার হিসেবেও তুলে ধরতে চেয়েছে। তারা ভুয়া দাবি করে, নবী মুহাম্মদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বংশধর হিসেবে তারা খেলাফতের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। এই দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে দরকার হয় একটি মৌলিক ধর্মতাত্ত্বিক ও বংশানুক্রমিক কাঠামোর—যা উমায়াদের আমলে অনুপস্থিত ছিল।
আব্বাসিরা শুরুতে কুরআনের তাফসিরের মাধ্যমে এই কাঠামো গঠনের চেষ্টা করে। কুরআনের আয়াতগুলোকে তারা নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে, এবং তাফসির সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। কিন্তু এখানে তারা এক বিরাট সীমাবদ্ধতায় পড়েন। কুরআন একটি বহুস্তরীয়, প্রায় আখ্যানধর্মী, সংকেতপূর্ণ ও ধারাবাহিকতাহীন টেক্সট। এতে সামাজিক বা আইনি কাঠামো নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত স্পষ্টতা নেই। যেমন নামাজ, রোজা, বিবাহ, উত্তরাধিকার, শাস্তি, শাসনব্যবস্থা এসব বিষয়ে কুরআন বরং ইঙ্গিতপূর্ণ ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেয়।
এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে গিয়ে আব্বাসিরা হাদিস সংকলনের দিকে এগিয়ে যায়। নবীর জীবনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া এই বিশাল সাহিত্যিক সংকলনগুলি আসলে ছিল একধরনের ঐতিহাসিক পুনর্গঠন। নবীকে এমন একজন চরিত্রে রূপ দেওয়া হয়, যিনি সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, এবং তার “সুন্নাহ” অনুসরণ করাই প্রকৃত ইসলাম। এইভাবে হাদিস হয়ে ওঠে ইসলামি আইনের মূল উৎস। ফলে ইসলাম একটি বিধানিক ধর্মে পরিণত হয়—যেখানে ফিকাহ, কিয়াস, ইজমা ইত্যাদির মতো ধারণা গড়ে ওঠে এবং তার ভিত্তিতে চারটি সুন্নি মাজহাব জন্ম নেয়।
উমায়াদরা ইসলামের আধ্যাত্মিক দিক বা নবীকে কেন্দ্র করে একটি বিশদ জীবনব্যাখ্যার প্রয়োজন অনুভব করেনি। কিন্তু আব্বাসিদের রাজনৈতিক বৈধতা, এবং একক ধর্মতাত্ত্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এটি ছিল অপরিহার্য। হাদিস ছাড়া কুরআনের উপর ভিত্তি করে তাদের কাঠামো দাঁড় করানো সম্ভব ছিল না। তাই বলা যায়, ইসলামের সেই বিশদ শারিয়াহভিত্তিক কাঠামো যেটি আজ আমরা চিনি—তা মূলত আব্বাসি যুগে হাদিস সংকলনের মাধ্যমে নির্মিত হয়। আমার অনুমান, কুরআনের ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলামের কাঠামো তৈরি সম্ভব হয়নি, এবং তাই হাদিস সৃষ্টি হয়।
No comments:
Post a Comment