Friday, June 20, 2025

বাঙালি মুসলমান, এতো ধর্ম-কর্ম করেও এমন অসভ্য কেন?

  

"আপনার প্রশ্ন— “বাঙালি মুসলমান, এতো ধর্ম-কর্ম করেও এমন অসভ্য কেন?” একটি উদাহরণ দিই। বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষ নামাজ পড়ে, এবং নামাজটা তারা শুরু করে আল্লাহু আকবার, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, সূরা ফাতিহা, এসব দিয়ে। আল্লাহু আকবার কী? আল্লাহ মহান। কিন্তু আল্লাহ মহান বলে যিনি তাহরিমা বাঁধছেন, তিনি কি আল্লাহর মতো মহান হতে চাইছেন? আল্লাহকে অনুসরণ করছেন? তা নয়। কেবল মুখস্ত বাক্য জপে সওয়াব কামাতে চাইছেন। তার বিশ্বাস, মহান হওয়ার দায় শুধু আল্লাহর একার, মানুষের মহান হওয়ার প্রয়োজন নেই।
তারপর বিসমিল্লাহ। নামাজ আল্লাহর নামে শুরু করা হচ্ছে, যিনি পরম করুণাময় ও অত্যন্ত দয়ালু। এ বাক্য থেকে নামাজীরা কিছু শিখছে? এখানে আল্লাহর দুটি গুণ বর্ণিত হয়েছে, করুণাময় ও দয়ালু, বাঙালি মুসলমান কি দয়ালু হতে চায়? তার মাঝে করুণার ছিটেফোঁটা আছে? সেদিন দেখলাম, একটি ছাগলকে, পেটে বাচ্চা আছে, গর্ভবতী চতুষ্পদ, দুটি কলা খেয়েছে বলে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। শিয়াল কুকুর, যাই দেখেন, তাকেই পেটাতে যান। অপছন্দের মানুষদের প্রতি অনুভব করেন তীব্র জিঘাংসা। নিজ ধর্মের লোক ছাড়া সকলকেই শত্রু মনে করেন। হিন্দু, ইহুদী, নাস্তিক, সবাইকে গালিগালাজ করেন। হত্যাযোগ্য মনে করেন। সুতরাং বিসমিল্লাহ থেকে তো আপনি কিছু শিখছে না। দয়া, করুণা, কমপ্যাসন, এসব আপনার ভেতর নেই। ইউ আর আ ক্রুয়েল এনিম্যাল।
নামাজে পাঁচবেলা আল্লাহ দয়ালু, আল্লাহ দয়ালু জপছেন, নিজে দয়ালু হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছেন না। শুধু আল্লাহ দয়ালু হলে পৃথিবীর কী লাভ? মানুষকে তো দয়ালু হতে হবে, না কি? পৃথিবীতে আল্লাহ বাস করেন না, মানুষ বাস করে। আপনি যদি আল্লায় বিশ্বাস করেন, তাহলে এটা বোঝার কথা যে মানুষ আল্লাহর বায়োলোজিক্যাল ম্যানিফেস্টেশন। আপনি দয়ালু হলেই আল্লাহ দয়ালু। আপনি নিষ্ঠুর হলে আল্লাহও নিষ্ঠুর।
ফাতিহার দিকে তাকান। এর প্রথম আয়াত কী? আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। এখানে কী বলা হলো? সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি মহাবিশ্বের রব বা প্রভু। ইবনে কাসিরে দেখলাম, এ আয়াতে প্রশংসা উচ্চারণের মূল কারণ— আল্লাহ মানুষকে যা যা দিয়েছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতা বা ঋণ স্বীকার করা। কারও দ্বারা উপকৃত হলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শিক্ষা এখানে রয়েছে। কিন্তু শিক্ষাটা কি নামাজীরা নিচ্ছে? বাঙালি সহজে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চায়? মুসলমানরা অনেক ওষুধ, ভ্যাক্সিন, ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যার পেছনে ইহুদী, খ্রিস্টান, হিন্দু, ও নাস্তিক বিজ্ঞানীদের অবদান আছে। সে-ঋণ কি তারা স্বীকার করে? করে না। উল্টো গালি দেয়। তাহলে আলহামদুলিল্লাহ পড়ে লাভটা কী? মুখস্ত প্রশংসায় আল্লাহর কিছু যায় আসে? প্রশংসা, এপ্রিশিয়েশন, এসব তো বেশি দরকার মানুষের। এক বাঙালি আরেক বাঙালিকে বলে নিমক-হারাম। কেন বলে? কারণ তাদের ভেতর কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। উপকারীর অপকার করতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। একটি শিশুর প্রশংসাও আমরা সহজে করতে চাই না।
আরেকটি বিষয় হলো, আল্লাহ কী? ইসলামী বিশ্বাস বলে, আল্লাহ এমন এক সত্ত্বা, যিনি জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, মহান, ক্ষমাশীল, ও ন্যায়বিচারক। যদি প্রশ্ন করি, আপনি রাতদিন আল্লাহর গুণগান গাইছেন, আল্লাহু আকবার বলে আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করছেন, আল্লাহ আল্লাহ করে আল্লাহর কান ঝালাপালা করে দিচ্ছেন, কিন্তু আল্লাহকে নকল করছেন না কেন? আল্লাহ জ্ঞানী, আর আপনি মূর্খ, আল্লাহ ন্যায়বিচারক, আপনি ভণ্ড, এতে আল্লাহর কোনো উপকার হলো? আল্লাহর একটি গুণও কি ধারণ করার চেষ্টা করছেন? যেসব গুণাবলীর জন্য আল্লাহর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, মুসলমানরা, আল্লাহর নামে সবকিছু শুরু করেন, সেসব গুণাবলী তো মানুষেরও আছে। মানুষের মাঝে যারা জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, ন্যায়বিচারক, তাদের প্রশংসা কি কখনো করেন? তাদের খোঁজখবর রাখেন?
যে-সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস করেন, সেখানে বহু জ্ঞানী লোক আছেন, যাদের কথা কখনো মুখফুটে স্বীকার করেন না। উল্টো কীভাবে তাদেরকে টেনে খাদে নামানো যায়, মিথ্যে নিন্দা ও কুৎসা প্রচার করা যায়, সে-ব্যবস্থা করছেন। আপনার চোখে জ্ঞানী কেবল বিশেষ ঘরানার লোকজন। বিশেষ ধর্মের লোকজন। বাঙালি নামাজীদের কি দেখা যায় নিউটন বা গ্যালিলিওর প্রশংসা করতে? তাদের মুখে বার্ট্রান্ড রাসেল বা ডারউইনের প্রশংসা কোনোদিন শুনতে পাবো? পাবো না। তার মানে কী দাঁড়ালো? সে শুধু মুখস্ত আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন পড়ছে, কিন্তু এর শিক্ষাটুকু হৃদয়ে ঢোকাচ্ছে না।
তার পরের আয়াতটা দেখুন, আর-রাহমানির রাহিম। এখানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমের বক্তব্যই পুনরায় এসেছে। আল্লাহ দয়ালু ও করুণাময়। নামাজীদের ধারণা, দয়ালু হওয়ার চাকরিটা শুধু আল্লাহই করবেন, মানুষ নয়। দয়া-মায়া খুব বিস্তৃত ও শক্তিশালী ব্যাপার। কেবল মানুষের প্রতি দয়া নয়, গাছের প্রতি, পাখির প্রতি, গরুর প্রতি, সবকিছুর প্রতিই দয়া থাকা জরুরী। অথচ মুসলমানরা অধিকাংশই নিষ্ঠুরতায় লিপ্ত। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর অধিকারে সে বিশ্বাস করে না। এবং মানুষের অধিকারেও, যদি না আক্রান্ত ব্যক্তিটি মুসলমান হয়, সে বিশ্বাস করে না।
তারপর মালিকিয়াও মিদ্দিন। এখানে কী বলা হলো? আল্লাহকে বিচার দিনের মালিক ঘোষণা করা হলো। আপনার যাবতীয় কাজকর্মের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে, এটি স্বীকার করছেন। কিন্তু যে-লোক এ আয়াত পড়ছে, সে কি এমনটা ভাবছে? ভাবছে না। সে দিনরাত মিথ্যে কথা বলছে, ঘৃণা, হিংসা, ক্রোধ, এসবের বশে অন্যের ক্ষতি করছে, ফেসবুকে ফেইক আইডি খুলে ইসলাম প্রচার করছে, বাস্তবে লুঙ্গিপরা ছেলে, কিন্তু প্রোফাইলে ছবি দিয়ে রেখেছে বুরকা পরা সুমাইয়ার, কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, ঘুষ খাচ্ছে, শো-অফ করছে, মালিকিয়াউমিদ্দিনের কথা মনে পড়ছে না, তাহলে লাভটা কী? সে মুখে বলছে মালিকিয়াও মিদ্দিন, আল্লাহ বিচার দিনের মালিক, কিন্তু কাজকর্মে ঘোষণা দিচ্ছে মিসকিনিয়াও মিদ্দিন। আল্লাহ বিচার দিনের ফকির।
তারপর ঈয়াকা না’বুদু ওয়া ঈয়াকা নাস্তায়ীন। আমরা তোমারই উপাসনা করি, তোমার কাছেই সাহায্য চাই। বাঙালি ভাবে, উপাসনা মানে শুধু ভক্তি বা পূজা করা। আসলে তা নয়। গাইডেন্স বা পরামর্শ চাওয়াও উপাসনা। আপনি জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ কারও পরামর্শ চাইছেন, তার দিক-নির্দেশনা মেনে চলছেন, এটি একপ্রকার উপাসনা। এর মানে কী দাঁড়ালো? নামাজে জ্ঞানী ও ক্ষমতাবান আল্লাহর সাহায্য চাইছেন, কিন্তু বাস্তবে মূর্খ ও ক্ষমতাহীনের সাহায্য খুঁজছেন। ক্ষমতা বলতে রাজনীতিক ক্ষমতা বুঝাচ্ছি না। রোগ সারানোর ক্ষমতা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের, কিন্তু নামাজীরা যাচ্ছে ক্ষমতাহীন কবিরাজ ও ঝাঁড়ফুঁকওয়ালা হুজুরের কাছে। অথবা এমন ডাক্তারের কাছে, যিনি কাগজে এমবিবিএস, হৃদয়ে মোল্লা। সংকটে জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞজনের সাহায্য চাইবেন, পরামর্শ খুঁজবেন, তাদের সান্নিধ্যে থাকবেন, এটিই তো এ আয়াতের শিক্ষা, নাকি? ঈয়াকা নাস্তায়ীন। অথচ মুসলমানরা রাতদিন বাচাল ও নির্বোধ লোকদের মাথায় নিয়ে নাচছে। শীতকালে মিথ্যেবাদী কথাশিল্পী ভাড়া করে আনছে। ওয়াজের নামে শুনছে ফালতু গল্প ও সুরেলা বিষ। কোনো জ্ঞানী লোকের ভাষণ শুনছে না। আহাম্মকদের কাছে প্রশ্ন পাঠাচ্ছে, মাওলানা সাব, এটা করা কি জায়েজ? এই হলো অবস্থা। আমি যদি বলি, আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করতে চান, কিন্তু সেটা জ্ঞানী লোকের মাধ্যমে, তাহলে? মনে হয় না মানবে। আসলে এরা সেজদাটুকুই দেয়। কিন্তু কেন দেয়, কাকে দেয়, এটা জানে না। ধর্মব্যবসার ফাঁদে পড়ে বাঙালি মুসলমান দিন দিন নির্বোধ হয়ে যাচ্ছে।
তারপরের আয়াতটা দেখুন, ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম, আর কী যেন, হ্যাঁ, সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম। আমাকে সরল পথে পরিচালিত করো, যে-পথে তুমি তোমার আশির্বাদপুষ্টদের, বা প্রিয় মানুষদের পরিচালিত করেছো। বাস্তবতাটা দেখুন, নামাজে সে আল্লাহর কাছে সোজা পথে চলার ইচ্ছা প্রকাশ করছে, কিন্তু নামাজের পর যতো বাঁকা পথ আছে, চিপাগলি আছে, সেগুলো দিয়ে হাঁটছে। কোনো কাজই সোজাভাবে করছে না। সৎ মনে দায়িত্ব পালন করছে না। প্রকাশ্যে আউলিয়া, গোপনে ডাকাত, ব্যভিচারী। সরকারি অফিসকে বানিয়ে ফেলেছে দোকান। সেবাগ্রহীতাকে ভাবছে প্রফিটেবল কাস্টমার। টাকা নিচ্ছে, টাকা দিচ্ছে। মানুষকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করছে। তো নামাজে ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম পড়ে কী লাভ হলো? নামাজের কোনো শিক্ষাই তো মগজে জমছে না।"
.
—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
বানরের আয়না, পৃষ্ঠা ২১ (অপ্রকাশিত)
Like
Comment
Share

No comments:

Post a Comment