শিশুকালের মনের আঘাত বা চাইল্ডহুড মেন্টাল ট্রমা অনেক বিষয়ে খুব বিপজ্জনক একটা জিনিষ। এটি মানুষের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বন্ধ করে দিতে পারে বা খুলে দিতে পারে বিপজ্জনক বা অর্থহীন জীবনযাত্রার দুয়ার। আমার বহু বন্ধু, বান্ধবী বা প্রেমিকা, যাদের সাথে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে আলাপ হয়, তাদের মধ্যেও দেখেছি সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক পরিপূর্ণ মানুষ, কোন এক শিশুকালের মনের আঘাতের কারণে কোন একটি বিশেষ বিষয়ে হয় অপরিণত অথবা বিকলাঙ্গ হয়ে বসে আছে। মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী যৌন অসাড়তা, অনিচ্ছা বা অক্ষমতা। আর পুরুষদের মধ্যে যৌনতা বা ধর্ম নিয়ে অস্বাভাবিক বা অতিশয় অনিয়ন্ত্রিত আচরণ। আমাদের দেশে না জেনে শুনে কিশোরীদের বিয়ে করাও শিশুকালের মনের আঘাতের সাথে সম্পৃক্ত। এমনকি বাস্তবের মানুষ ও জীবনকে ভাল না বেশে বেহেশতের ৭২ হুর পরীর আশায় নিজের ও নিকটজনের বার রাষ্ট্রের ভবিষ্যত ধ্বংস কারাটাও শিশুকালের মনের আঘাতের কারণে হতে পারে।
শিশুকালের মনের আঘাত মানুষকে একটি কষ্টের স্মৃতি নির্ভর মূল্যবোধ ব্যবস্থা বা ভ্যাল্যু সিস্টেমে স্থায়ী বা ফিক্সড করে দেয়। সে তার চিন্তাপ্রক্রিয়া বা কগনিশন অথবা তার অভিজ্ঞতা দিয়ে সেটা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। ঐ বিশেষ বিষয়ে সে বাস্তবতাকে স্মৃতি থেকে তৈরি পূর্বতন অভিজ্ঞতা বা তার প্রতিক্রিয়ার আলোকে দেখে থাকে।
এই বিষয়টি ভ্লাদিমির নবোকভ তার লোলিটা উপন্যাসে এঁকে দিয়ে গেছেন সার্থকভাবে। শিশুকালের মনের আঘাত কিভাবে একটি পরিণত মানুষকে বাস্তবতাকে ফ্যান্টাসির জগতে নিয়ে যায় যেখানে সে সব রকম সামাজিক মূল্যবোধের সারিকে অগ্রাহ্য করে, তার প্রকৃত দলিল হচ্ছে নবোকভের লোলিটা। সেটা এই কারণ নয় যে এটা অসাধারণ উপন্যাস। সেটা এই কারণে যে সেটা এত জনপ্রিয় এবং কোটি কোটি মানুষ যেন সেই ফ্যান্টাসির জগতে ডুবে গিয়েছে বাস্তবতা অগ্রাহ্য করে।
ললিতার কাহিনিসংক্ষেপ
উপন্যাসটি প্রথম ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা, যেখানে প্রধান চরিত্র এবং বর্ণনাকারী হাম্বার্ট হাম্বার্ট নিজের জীবনের ঘটনাবলি বর্ণনা করেন। হাম্বার্ট একজন মধ্যবয়সী ইউরোপীয় সাহিত্যের অধ্যাপক, যিনি আমেরিকায় এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি নিজেকে একজন "নিম্ফেট" (যারা অপ্রাপ্ত বয়স্কাদের প্রতি আকর্ষিত হয়) প্রেমিক হিসেবে বর্ণনা করেন, যারা ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরী মেয়েদের মধ্যে একটি বিশেষ যৌন ও নান্দনিক আকর্ষণ অনুভব করে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো ডলোরেস হেজ, যাকে হাম্বার্ট ডাকে "ললিতা" নামে।
গল্পের শুরু: হাম্বার্টের অতীত
হাম্বার্ট তার শৈশবের একটি ট্র্যাজিক প্রেমের গল্প দিয়ে উপন্যাস শুরু করেন। তিনি বর্ণনা করেন কীভাবে তিনি কিশোর বয়সে আনাবেল নামের একটি মেয়ের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু আনাবেলের অকাল মৃত্যু হাম্বার্টের মনে একটি স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে, যা তার জীবনের পরবর্তী আচরণ ও আকর্ষণের মূল কারণ হয়ে ওঠে। তিনি বিশ্বাস করেন যে তার এই "নিম্ফেট" প্রতি আকর্ষণ আনাবেলের স্মৃতির সাথে জড়িত।
আমেরিকায় আগমন ও ললিতার সাথে সাক্ষাৎ
১৯৪০-এর দশকে হাম্বার্ট আমেরিকায় চলে আসেন এবং নিউ ইংল্যান্ডের একটি ছোট শহর র্যামসডেলে বাসা ভাড়া নেন। তিনি শার্লট হেজ নামের এক বিধবা মহিলার বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। শার্লটের ১২ বছর বয়সী মেয়ে ডলোরেস, যাকে হাম্বার্ট "ললিতা" নামে ডাকেন, তাকে দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ মুগ্ধ হয়ে পড়েন। ললিতার স্বাভাবিক সৌন্দর্য, কিশোরী আচরণ এবং নির্দোষতা হাম্বার্টের অসুস্থ আকর্ষণকে জাগিয়ে তোলে। তিনি তার ডায়েরিতে ললিতার প্রতি তার অনুভূতি এবং কল্পনার বিস্তারিত বর্ণনা লিখতে শুরু করেন।
শার্লটের সাথে বিয়ে
হাম্বার্ট বুঝতে পারেন যে ললিতার কাছাকাছি থাকার জন্য তাকে শার্লটের সাথে সম্পর্ক গড়তে হবে। শার্লট, যিনি হাম্বার্টের প্রতি আকৃষ্ট, তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। হাম্বার্ট শার্লটকে বিয়ে করেন, কিন্তু তার উদ্দেশ্য শুধুই ললিতার কাছাকাছি থাকা। তিনি শার্লটের প্রতি কোনো সত্যিকারের ভালোবাসা বা আকর্ষণ অনুভব করেন না।
শার্লটের মৃত্যু
একদিন শার্লট হাম্বার্টের ডায়েরি পড়ে ফেলেন এবং তার ললিতার প্রতি অসুস্থ আকর্ষণের কথা জানতে পারেন। ক্রোধে ও হতাশায় তিনি হাম্বার্টের সাথে তর্ক করেন এবং রাস্তায় ছুটে যাওয়ার সময় একটি গাড়ির নিচে পড়ে মারা যান। শার্লটের মৃত্যু হাম্বার্টের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে, কারণ তিনি এখন ললিতার আইনি অভিভাবক হয়ে ওঠেন।
ললিতার সাথে সম্পর্ক
শার্লটের মৃত্যুর পর হাম্বার্ট ললিতাকে তার মায়ের মৃত্যুর কথা না জানিয়ে একটি সড়ক ভ্রমণে নিয়ে যান। তিনি ললিতার সাথে একটি যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা তিনি তার বর্ণনায় নান্দনিক ও রোমান্টিক আলোয় উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাস্তবে এটি একটি শোষণমূলক ও নিষিদ্ধ সম্পর্ক। ললিতা, যিনি একজন কিশোরী, এই সম্পর্কের শিকার হন এবং তার নিজের ইচ্ছা বা স্বাধীনতা প্রকাশের সুযোগ পান না।
সড়ক পথে ভ্রমণ ও পলায়ন
হাম্বার্ট এবং ললিতা আমেরিকার বিভিন্ন অংশে একটি দীর্ঘ সড়ক পথে ভ্রমণে যান। এই সময়ে হাম্বার্ট ললিতার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন, তার স্বাধীনতা হরণ করেন এবং তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্পর্কে আবদ্ধ রাখেন। তবে ললিতা ধীরে ধীরে হাম্বার্টের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তিনি তার নিজের পরিচয় ও ইচ্ছা খুঁজে পেতে চান। এই সময়ে হাম্বার্ট লক্ষ্য করেন যে তাদের পিছু পিছু একটি রহস্যময় ব্যক্তি তাদের অনুসরণ করছে।
পরে জানা যায় যে এই ব্যক্তি ক্লেয়ার কুইল্টি, একজন নাট্যকার এবং ললিতার আরেকজন পরিচিত। ললিতা শেষ পর্যন্ত কুইল্টির সাথে পালিয়ে যান, হাম্বার্টকে পরিত্যাগ করে।
ললিতার পুনর্মিলন ও সমাপ্তি
কয়েক বছর পর হাম্বার্ট ললিতার সন্ধান পান। এখন ললিতা ১৭ বছর বয়সী, বিবাহিত এবং গর্ভবতী। তিনি একটি সাধারণ, দরিদ্র জীবনযাপন করছেন। হাম্বার্ট তাকে আবার তার সাথে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন, কিন্তু ললিতা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান যে তিনি কুইল্টির সাথে সম্পর্কে ছিলেন, কিন্তু কুইল্টিও তাকে পরিত্যাগ করেছেন। হাম্বার্ট ললিতাকে কিছু টাকা দিয়ে চলে যান।
ক্রোধে ও হতাশায় হাম্বার্ট কুইল্টিকে খুঁজে বের করেন এবং তাকে হত্যা করেন। উপন্যাসের শেষে হাম্বার্টকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং তিনি জেলে বসে তার স্মৃতিকথা লেখেন। তিনি তার গল্পে ললিতার প্রতি তার ভালোবাসা ও তার অপরাধবোধের কথা প্রকাশ করেন। উপন্যাসটি শেষ হয় হাম্বার্টের মৃত্যু এবং ললিতারও প্রসবজনিত জটিলতায় মৃত্যুর মাধ্যমে।
পরিশেষে লেলিটা কিশোরী নারীর প্রতি অবসেশনের কাহিনী। নবোকভের লোলিটার সমালোচনায় আমেরিকায় কম্পারেটিভ সাহিত্যের অধ্যাপিকা স্ভেতলানা বৈম (Svetlana Boym) বলেছেন এটা প্রেমও নয়, যৌনতাও নয় - লোলিটা একটা নষ্টালজিয়া। দেশ ছেড়ে গেলে যেমন দেশের চমৎকার অভিজ্ঞতাটি মানুষের মনে সবসময় ছেয়ে থাকে, যে প্রেম কখনও আর পাওয়া হবে না, কৈশোরের ঐ প্রথম প্রেমের স্মৃতিই পরিণত জীবনকে আচ্ছন্ন করে রাখে যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। তাই লোলিটা আসলে একটি বিভ্রম।
সিরাজুল হোসেন
No comments:
Post a Comment